শারণ্যপ্রভা
সে ছিল এক ভট্টাচার্য্যি বাবু; নামটা...অজানা নয়; তবুও
উহ্যই থাক। সেদিন ছিল শীতের দুপুর। ছাদের
ওপর মাদুর পেতে বসেছিলাম আমি তনু ;মানে তানিয়া..., তোমার মুখোমুখি। ঝলমলে
রোদ গায়ে মেখে চলছিল প্রেম প্রেম খেলা। খেলাই বটে! অবশ্য পনেরো বছরের তনু জানতই না
প্রেম কি, ভালবাসা কি? শুধু জানত তার প্রিয় মানুষটিকে; ছয় ফুট লম্বা, ফর্সা,
সুন্দর ছেলেটার মধ্যে কি যে দেখেছিল সে?
তার চোখে চোখ রাখলেই হৃদয়ের কম্পন মাত্রা দ্বিগুন হত। তার হাতে হাত রাখলেই
সমস্ত শরীর জুড়ে বিদ্যুৎ খেলে যেত। স্কুল থেকে ফিরে কোনরকমে নাকে মুখে গুঁজে চলে
আসত ছাদে। জানত যে সে এখানেই পাবে তার প্রিয়তমকে, একান্তে। “ কেন এমন হয়?” বোকা
মেয়েটা প্রশ্ন করেছিল।
উত্তর দাও নি তুমি। শুধু মুচকি হেসেছিলে আর তোমার
হাসিতে আমি নিজেকে ভরিয়ে নিয়েছিলাম। কি অদ্ভুত একটা ভাল লাগা পেয়ে বসেছিল আমাকে!
কি অপূর্ব ছিল আমাদের সেই প্রেম! হঠাৎ আকাশ জুড়ে মেঘের ঘনঘটা। হুড়মুড় করে বৃষ্টি
নামল ধেয়ে। যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্য রাজার পূন্য দেশ। খনার বচন। আমার বাংলা সেই
বৃষ্টিতে শস্যশ্যামলায় ভরে উঠেছিল কিনা মনে নেই। কিন্তু মনে আছে, চিলেকোঠার ঘরে
তুমি আমায় ভরিয়ে দিয়েছিলে আদরে আর চুমুতে। সে কি ছিল? ভালবাসা? না মোহ? যদি জানতাম
সেটা এক মুহূর্তের দূর্বলতা, ভাবতাম মোহ। কিন্তু এমনি করে না হোক, তুমি আমায়
ভালবাসাতে ভরিয়ে দিয়েছিলে বারবার, কতবার; পুজোর প্যান্ডেলে গানের আসরে তোমার দৃষ্টি
দিয়ে কিংবা রাঁচি থেকে ফিরে আসার পর দোলের দিনে, লাল আবির হাতে অথবা বাবা-মা
বাড়িতে ছিলেন না বলে সেদিন যখন রান্না করতে গিয়ে পুড়ে গেলাম; তুমি কি সুন্দর করে হলুদ ক্রিমটা লাগিয়ে দিয়েছিলে আমার
হাতে। নিজের হাতে নুডুলস রান্না করে খাইয়ে দিয়েছিলে আমায়। সেটা কি করে ভালবাসা না
হয়ে থাকে? আর সেই মন খারাপ করা, বোরিং দিনগুলোতে স্কার্ট পরা টিনেজ মেয়েটা খিলখিল
করে হেসে না ওঠা পর্যন্ত বস্তাপচা কমিকস্ গুলো শুনিয়ে যাওয়া, সে কি শুধুই খেলা?
পড়তে বসলেই বইয়ের পাতায় তুমি ভেসে উঠতে। কখনো হাসতে, কখনো
চোখে চোখে কথা বলতে, কখনো বা এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে। আমি বইয়ের পড়া পড়তেই ভুলে যেতাম।
তোমার হৃদয়ের ভাষা পড়তে চাইতাম; বারবার, কতবার। ফলস্বরূপ যে মেয়েটা স্কুলে
স্ট্যাণ্ড করত; সে কোনরকমে সেকেণ্ড ডিভিসান হবার হাত থেকে বেঁচেছিল। দাদা আমায়
লাঠি দিয়ে খুব মেরেছিল। আমার হাতে, পিঠে কালসিটে পড়ে গিয়েছিল। দেখে তুমি কষ্ট
পেয়েছিলে। আমি তোমার বুকে মুখ গুঁজে কেঁদেছিলাম।
“তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে তনু? আমার জন্যে তোমার রেজাল্ট
খারাপ হল?”
“উঁহু। তুমি এমনি করে আমায় ভালবাসলে আমার সব কষ্ট কোথায়
চলে যাবে...”
তুমি সেদিন আমার ঠোঁটে দ্বিতীয় বার চুমু খেলে। আবার আমি
নিজেকে ভরিয়ে নিলাম তোমার আদরে, তোমার পারফিউমের গন্ধে।
শুনেছিলাম, সত্যিকারের প্রেম নাকি চাপা থাকে না, এমনই তার
সুবাস। আমাদের প্রেমও চাপা রইল না। বাবা ধমকে উঠলেন, “তুমি এখনও উচ্চ মাধ্যমিক দাও
নি। এরই মধ্যে এসব? তাছাড়া ও তোমার থেকে বারো বছরের বড়। একটা সাধারণ মেডিকেল
রিপ্রেজেন্টটেটিভের চাকরী করে। তোমাকে খাওয়াতে পারবে?”
বাবার রাগ করাটাই স্বাভাবিক। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের মস্ত
বড় অফিসার ছিলেন; দাদাও ইঞ্জিনীয়ারিং করে এম. বি. য়ে করছে। নামী তেলের কোম্পানীতে
জয়নিং সামনের মাসে। মেডিকেল রিপ্রেজেন্টটেটিভ জামাই হলে তাঁদের প্রেস্টিজের একশেষ।
কিন্তু আমার মন যে মানে না। উত্তর কলকাতার জোড়ালাগা দুই বাড়ির ছাদের মাঝের
পাঁচিলের এ পাশে দাঁড়িয়ে আমি বললাম, “ চলো আমরা পালিয়ে যাই...” ও পাশ থেকে জবাব
এল। “ না। তা হয় না।” এতদিনে পাঁচিল পেরিয়ে এ পাশে আসা তোমার বন্ধ হয়েছিল। আমারও
যাওয়া নিষেধ ছিল। এবার মাঝখানের পাঁচিলটা প্রায় আকাশচুম্বী উঁচু করে দেওয়া হল দুই
বাড়ির সহমতে। তোমার কষ্ট হয়েছিল কিনা জানি না; আমি শুধু ছাদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
চোখের জল ফেলছিলাম।
‘ আমার কি কিছুই করার নেই?’ নিজেকে প্রশ্ন করলাম; বারবার।
‘ তুমিও কেন কিছু করছো না? কতদিন তোমাকে দেখিনি...ছটফট করতে করতে মরে যাব যে!’
আমি কোন কিছুর পরোয়া না করে, লজ্জা শরমকে বনবাসে পাঠিয়ে
ছুটে গেলাম তোমাদের বাড়ি। জেঠিমনির পায়ের কাছে বসে বললাম, “ আমাকে তাড়িয়ে দিও না।
আমি যে ভালবেসেছি...”
“তা হয় না। তুমি ফিরে যাও। তোমার বাবা জানতে পারলে শুধু
শুধু আমাদের বদনাম করবেন। তাছাড়া পাড়ায় জানাজানি হলে...কি কেচ্ছা কি কেচ্ছা!”
উঠে দাঁড়ালাম আমি। চোখের জল মুছলাম ঠিকই; কিন্তু অনেক
প্রশ্নের ছায়া লেগেই থাকল। দেখলাম তুমি মাথা নীচু করে নিজের ঘরে চলে গেলে। তোমার
চোখে মুখেও বেদনার ছাপ দেখেছিলাম। সে কি মিথ্যে?
পরেরদিন স্কুল থেকে ফিরতেই জেঠিমনির গম্ভীর গলার স্বর কানে
এল।
“আপনার মেয়েকে সামলান মি: দত্ত। আমরা ব্রাহ্মণ বংশ। আমাদের
ঘরের মেয়ে বউদের দেখেছেন তো? সকলেই ডাকসাইটে সুন্দরী। আপনার দাদা চান যে আমার ঘরেও
লাল টুকটুকে বউ আসুক, ফর্সা পায়ে নুপুর পরে ঘুরে বেড়াক ঘর জুড়ে। এছাড়া নীচু বংশে
ছেলের বিয়ে দেব এমন খারাপ অবস্থা এখনও আমাদের হয়নি।”
সেদিনই সন্ধ্যায় আমি সরোবরের ধারে তোমার আড্ডার ঠেকে
গেলাম। তোমায় প্রশ্ন করলাম,
“ তুমিও কি তোমার মায়ের সঙ্গে একমত?”
“কি বিষয়ে?”
বুঝলাম তুমি বুঝেও না বোঝার ভান করছো।
“তুমি আমাকে বিয়ে করবে কিনা?”
তোমার বন্ধুদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। মুখ চেপে হাসছিল ওরা।
তুমি আমাকে আড়ালে নিয়ে গেলে এবং অত্যন্ত রূঢ় স্বরে বললে,
“তনু প্রেম আর বিয়ে তো এক জিনিষ নয়। বিয়েটা ছেলেখেলা নয়...”
আমি তোমার কথা একবর্ণও বুঝতে পারছিলাম না, বিশ্বাস কর।
শরীরের ভেতর কে যেন আগুন নিয়ে খেলা করতে লাগল।
“মানে...?”
“আর কিছুই নয়। তুমি ভুলে যাও আমাকে। আর এমনিতেও আমি সামনের
মাসে রাঁচি চলে যাচ্ছি...”
সব শেষ করে দিলে দুটো কথায়। কত দূরে ঠেলে দিলে দুলাইনের
কথা দিয়ে। আমি কিন্তু কিছু আর বলিনি তোমাকে; কোনদিনও না। আমার
অভিমান আমাকে তোমার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। কষ্ট পেয়েছিলাম খুব। তবে আরো কষ্টের তখনও বাকী ছিল। যখন
মাস ছয়েক বাদে তুমি রাঁচি থেকে বিয়ে করে ফিরলে; যদিও সে ব্রাহ্মণ ছিল না, সেন।
বদ্যি; সে বংশে নাকি বিয়ে করা যায়। জেঠিমনি বৌভাতের কার্ড দিতে এসে বলছিলেন। এক
ঝলক দেখেছিলাম তাকে। খুব ফর্সা, লম্বা, সুন্দরী সে। আমার মত কালো, বেঁটে, রোগা নয়।
তোমার আত্মীয় স্বজনরা তার রূপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমার
থেকে কয়েক বছরের বড় ছিল সে। পরে, রাস্তায় কয়েকবার চোখাচোখি হয়েছিল; মনে হত সে যেন
ব্যঙ্গ করে হাসছে। তুমি কি তাকে সব কিছু জানিয়েছিলে?
সেদিন প্রথমবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখলাম। ‘সত্যি
কি তাই? আমি কি খুব খারাপ দেখতে? রূপ কি ভালবাসার চাইতেও দামী?’ নিজেকে নিকৃষ্ট
থেকে নিকৃষ্টতম মনে হচ্ছিল সেদিন। কিন্তু আমার কি দোষ? আমি তো ইচ্ছে করে খারাপ
দেখতে হইনি? আমি তো ইচ্ছে করে নীচু বংশে জন্মাইনি। তবে আমার রূপ, আমার জাতি কিভাবে আমার ভালবাসার মাপকাঠি
হতে পারে? প্রশ্ন গুলো আমায় দগ্ধে দগ্ধে
মারছিল আর সেই সঙ্গে সানাইয়ের করুন আওয়াজ। তোমার বিয়ের সানাই, তোমার বাড়ি থেকে যা
ভেসে আসছিল; আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। ইচ্ছে হল দূরে, অনেক দূরে কোথাও পালিয়ে যাই।
আমি চলে যেতে পারতাম; কিন্তু গেলাম না। বাবা বললেন, “আমি
তোর জন্যে এম. বি. বি. এস পাত্র জোগাড় করে আনব, তুই শুধু উচ্চমাধ্যমিকে ফার্স্ট
ডিভিসানে পাশটা কর মা...”
মা বললেন, “ সহ্য করতে শেখ মা; মেয়ে হয়ে জন্মেছিস...”।
দাদা বলল, “তনু তুই জানিস তুই কত ট্যালেন্টেড...প্রেম টেম ওসব বাদ দে তো...”
আবার আয়নার মুখোমুখি হলাম। আমি দেখতে ভাল নই তো কি হয়েছে?
আমি লেখাপড়ায় ভাল। আমি ভাল গান গাইতে পারি। আমি নাচতে পারি...আমি আঁকতে পারি। আমি
কারোর থেকে কম কিসে? শুধুমাত্র মনের জোরে উচ্চমাধ্যমিকে স্টার মার্কস পেলাম। এক
হাতে চোখের জল মুছতাম আর এক হাতে সাদা খাতা লিখে লিখে ভরিয়ে দিতাম। আমার অধ্যাবসায়
আমাকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল। কিন্তু তবুও তোমার মায়ের বলা কথাটা
আমাকে মাঝেমধ্যেই খোঁচা দিত। আর তোমার ঐ চুমু; মাঝরাতে আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিত।
ক্রমে গ্র্যাজুয়েশান, মাস্টার্স করলাম। কলেজের দিনগুলো অসহ্য,
বোরিং ছিল আমার কাছে। অন্য বান্ধবীদের দেখতাম প্রেমিকের সঙ্গে সিনেমা যাচ্ছে;
ডেটিং এ যাচ্ছে। আমি কিন্তু বই মুখে করেই পড়ে থাকতাম। রেজাল্ট ভাল করতে হবে তাই
জন্যে কি? না। ভয় পেতাম। কোন ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে ভয় পেতাম আমি। অসুন্দর বলে
সেও যদি আমায় ছেড়ে চলে যায়। তবুও দু-একজন যে আমার কাছে আসতে চায় নি তা নয়। তবে
অচিরেই বুঝেছিলাম আমি শুধু তাদের টাইম পাশ। তাই হেসে সরে গিয়েছিলাম। তাতে অবশ্য
আমার লাভই হয়েছিল। কঠিন পরীক্ষাতেও ফার্স্টক্লাশ পেয়েছিলাম। চাকরীর পরীক্ষা দিলে
ঠিকই সরকারী চাকরী পেয়ে যেতাম। কিন্তু চাকরী করার ইচ্ছে ছিল না। এক জায়গায় বসে কাজ
করব এমন ইচ্ছে হচ্ছিল না। তাই যাদবপুরে জার্নালিজম কোর্সে ভর্তি হলাম। তবে সেটা
অন্য কেউ চেয়েছিল বলেই। হঠাৎই সে এল ধুমকেতুর মত। তুমি জানতেও পারলে না। কারণ
ততদিনে তোমাদের বাড়িটা ভেঙে ফ্ল্যাট উঠেছে আর তোমরা টাকা নিয়ে সোনারপুর না রাজপুর
কোথায় যেন চলে গিয়েছো। তবে তোমার বউ পুরাতন বাড়িতেই সন্দেশের ডেলার মত সাদা ধবধবে
শিশুপুত্রের জন্ম দিয়েছিল।
শারণ্য দাশগুপ্ত।
দাদার অফিসের বন্ধু। অ্যাড-মেকিং এর সূত্র ধরে দাদার সঙ্গে তার আলাপ। তারপর আমাদের
বাড়িতে যাতায়াত। সে যেন এক নতুন আয়না।
আমাকে নতুন করে চিনতে শেখাল। শারণ্য আর্ট
কলেজের পার্ট টাইমার; খুব সুন্দর ছবি আঁকে আর ততোধিক সুন্দর কথা বলে; যদিও চেহারার দিক
থেকে মোটেই ইম্প্রেসিভ নয়। তবুও আমার ওকে বেশ লাগে। সেই তো আমায় বলল...প্রথমবার...,
“তোমার চোখ দুটো খুব সুন্দর। তুমি কি জানো তানিয়া?”
“কই? না তো?”
“হুম। গভীর, এক্সপ্রেসিভ। কত কি বলছে যেন আর ঠোঁট দুটোও।
প্রজাপতি হয়ে ডানা মেলতে চায়...”
“তুমি কাব্য করছো?” আমি হেসে উড়িয়ে দিতে চাইলাম। কিন্তু ও
সেটা প্রমাণ করেই ছাড়ল। ওর এক বান্ধবীর কাছে পাঠালো আমার মেক ওভারের জন্যে; গ্রুমিং করতে। আমি যেতে
চাইছিলাম না মোটেই। মৃদু বকা দিল।
“তুমি জার্নালিজম করছো, ক’দিন বাদে অ্যাংকারিং করতে হতে
পারে। এসব না করলে বড় বড় মিডিয়া হাউস তোমাকে ডাকবে?”
তবে চলার পথটা সহজ ছিল না মোটেই। শুধু গ্রুমিং করে কি আর
ভাল মডেল হওয়া যায়? না কি অভিনয় করা যায়? কিংবা ভাল আর্টিকেলও লেখা যায় না। শারণ্য
বলে, “মনটা সজীব রাখো...তোমার চারিপাশ থেকে ইন্সপিরেশান নাও...মনটা উদার করো...যত
বাধা আসবে, জেনো তুমি ঠিক পথে চলছো।” বাধা আসতেও থাকল। ছোট ছোট মিডিয়া হাউসও আমায়
রিজেক্ট করল। গ্রাউণ্ড চ্যানেলও আমাকে অ্যাঙ্কারিং এর সুযোগ দিল না। কেউ কেউ তো
তার শয্যাসঙ্গী হবার অফারও দিল। আমি হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরতাম রোজ। দাদা বলত, “তোর
দ্বারা কিস্যু হবে না।” বাবা বললেন, স্কুল টিচারের পরীক্ষায় বোস, যদি কিছু হয়।” আর
মা বিয়ের জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। আর আমি? লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতাম রাতে; আর পরেরদিন
আবার নতুন পরীক্ষার জন্যে প্রস্তুত করতাম নিজেকে। শুধু শারণ্য সরে যায়নি আমার পাশ
থেকে। বলত, “ হতাশ হলেই সব শেষ। এই হেরে যাওয়াটাই তোমাকে পরিণত করছে, জানবে।”
ওর কথাই সত্যি হল। মিডিয়া হাউসে ইন্টারভিউর অভিজ্ঞতা নিয়ে
লেখা একটা আর্টিকেল কিঞ্চিৎ সাড়া ফেলে দিল। সোসাল মিডিয়ার দৌলতে আমার আরো আর্টিকেল প্রচারের আলোতে এল। দু-একটি
অকেশানে ডিবেট কিংবা নির্দিষ্ট বিষয়ে বক্তব্য রাখার সুযোগ পেলাম। মঞ্চে দাঁড়িয়ে
বুঝলাম যে আজকের দিনে শুধু ভাল লিখলেই হবে না; ভাল কথা বললেই হবে না; নিজেকেও
ততোধিক সুন্দর না হোক গ্রহণযোগ্য করে গড়ে
তুলতে হবে।
শারণ্যকে জানালাম আমার উপলব্ধির কথা। সে মুচকি হাসল। তার
অনুপ্রেরণাতেই আমি নিজেকে বদলে ফেলতে থাকলাম এমনভাবে যাতে আমার পোষাকের রঙ, আমার
ভাষা, আমার স্টাইল আর পাঁচজনের অনুকরনীয় হতে পারে। তারপর যেদিন প্রথম আমি ওর মডেল
হলাম; প্রথম যেদিন ও আমার ছবি আঁকল, প্রথম যেদিন ও আমাকে ক্যামেরা বন্দী করল,
সেদিন আমি নিজেই নিজেকে চিনতে পারছিলাম না। ক্যানভাসে আমি? এডিটেড আমি? এ কোন আমি?
“ এ...কি সত্যিই আমি?” লজ্জাও পাচ্ছিলাম। আবার গর্ব বোধও
করছিলাম। আর অপেক্ষা নয়। সেদিন মনে,
প্রাণে, দেহে সমর্পিতা হলাম...শারণ্যর কাছে; একজন পুরুষ মানুষের কাছে। সেদিন থেকেই
আমি শারণ্যপ্রভা। ঐ নামেই আমাকে আঁকে সে। এমনকি ডিজিটাল ফটোগ্রাফিতেও আমার মডেলিং
এর যে সমস্ত কভারেজ ও করেছে সেগুলোর নীচে ঐ নামটাই দেখা যায়। তাই আজ আমি ঐ নামেই
বিখ্যাত। সোসাল মিডিয়াতে আমার কিছু ফ্যানস
হয়েছে, অ্যাডমায়ারারস হয়েছে। সেখানে আমার প্রোফাইলের নামও তাই...।
তুমি বোধহয় বুঝতে পারনি; কিংবা চিনতে ভুল করেছিলে, তাই
হয়তো ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলে। আমি কিন্তু অ্যাকসেপ্ট করেছি। তোমার ওপর আমার
কোন রাগ নেই। কোন অভিমানও নেই। আমি তোমায় ক্ষমা করে দিয়েছি কবেই। তবে তোমার
অপরাধটাকে মনে পুষে রেখেছি। তা নাহলে সেদিনের সেই কালো, বেঁটে মেয়েটা আজকের হট
অ্যান্ড হ্যাপেনিং হতো কি করে বলো?
তোমার জন্যে আমার করুণাও
হয়। যখন দেখি তুমি ৪৫ বছর বয়সেই কতটা বুড়ো হয়ে গিয়েছো। মাথায় এতবড় টাক, কতবড়
ভূঁড়ি; চেনাই দায়। আর তোমার সুন্দরী বউ মোটাসোটা গিন্নিবান্যি হয়ে উঠেছে। আমার
থেকে মাত্র দু বছরের বড় ছিল নাকি? সত্যিই আজকে আমি তোমাদের পাশে একেবারে বেমানান।
তোমার পোস্টগুলো দেখে বুঝতে পারি, তুমি বউয়ের ফাইফরমাশ খাটতে খাটতে আর সংসারের ধকল
সামলাতে সামলাতে ক্লান্ত। তার ওপর তোমার ছেলে যখন ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ছে আর তার খরচ
চালাতে নিশ্চয় তোমরা হিমসিম খাচ্ছো। এখনও তুমি সেই মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ।
আমি নিজে ধরা না দিলে তুমি আমায় ধরতেই পারতে না। মানে
সেদিন তোমার চ্যাটিং বক্সটা আমি ইচ্ছে করেই ওপেন করে দিয়েছিলাম। দেখতে চাইছিলাম যে
তুমি কি বলো? সেদিন থেকে আজ অবধি রোজই তুমি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছো কিন্তু আমিই
সময় করে উঠতে পারি নি। কিংবা বলতে পারো মুড ছিল না আমার। তার মানে এই নয় যে আমি
মানুষকে অপমান করতে ভালবাসি । একদম তা নয়। আমি সকলের সঙ্গেই কথা বলি। আমার
চারপাশের মানুষরা জানে, আমি কতটা বিনয়ী। মাঝে-মধ্যে এর জন্যে শারণ্যের কাছে, দাদার
কাছে বকাও খাই। “ তুই যার তার সঙ্গে কথা বলে নিজের প্রেস্টিজ ডাউন করছিস
কিন্তু...” আসলে তা নয়। বাইরের আমি’র অনেক পরিবর্তন হয়েছে একথা সত্য। কিন্তু
ভিতরের মানুষটা তো আজও সাধারণ, ডাউন-টু-আর্থ। আমারও দু একবার ইচ্ছে হয়েছিল যে
তোমায় জিজ্ঞেস করি, “ কেমন আছো ?” নিজেই নিজেকে সংযত করেছিলাম। শুকিয়ে যাওয়া
ক্ষতটা যদি জেগে ওঠে।
সেদিক দিয়ে তুমি সফল হয়েছো। প্রতিদিন নানারকম
প্রশংসা বাণী আমার ছবির নীচে, কমেন্টস বক্সে, আমাকে কতরকম প্রশ্ন; কত জমে থাকা কথা
তোমার, যেন তোমার থেকে ভাল আমাকে আর কেউ চেনেই না; মেসেঞ্জার বক্স ভরিয়ে লিখেছো।
জাগিয়ে দিলে তুমি পুরাতন আগ্নেয়গিরিটাকে? জাগিয়েছো যখন গরম- উত্তপ্ত লাভার স্পর্শ
তোমায় যে পেতেই হবে। ঘন্টার পর ঘন্টা চ্যাট করার সময় আমার নেই। তাই অল্প কথায়
তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি:
“সূর্য্য তো উঠেছিল সেদিনও, মেঘের আড়ালে,
মেঘ দেখে ফিরে গেছো...
আর আমি গড়েছি নিজেকে, সেই সূর্য্যের ছোঁয়া পেয়ে...
রামধনুর রঙে সেজেছি আবার... তাই
ভিড়ের মাঝে খুঁজে চলেছো...
দেখতে যদিও পাও, পাবে না পরশ,
সুনীল আকাশে নিবাস আমার,
উজ্জ্বল নক্ষ্যত্র হয়ে জ্বলতে পারি,
আঁধারে আলো ছড়াতে পারি,
তবুও ফিরে পাবে না, তা...
যা একবার হারিয়েছো।।
শ্রী বাপ্পাদিত্য
ভট্টাচার্য্য মহাশয়কে শারণ্যপ্রভার তরফ থেকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা।।”
******************************
মৌসুমী
প্রামাণিক
১৫সি, সুরা ক্রশ লেন, কলকাতা-৭০০০১০
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন