ফাটল ধরার আগের মুহূর্তের ভেংচি
সম্পূর্ণা
খেলায়
ব্যস্ত
রোয়াকে।
বছর
পাঁচেকের
মেয়েটার
সঙ্গে
এ পাড়ায়
যদিও
কারোরই
তেমন
সদ্ভাব
নেই।
তবু
রোজ
নিয়ম
করে
সম্পূর্ণা
দোতলার
তাদের
ছোট্ট
ফ্ল্যাটটা
থেকে
নেমে
দারোয়ান
ভগবান
চাচার
ঘরে
চলে
যায়
দুপুর
নাগাদ।
ভগবান-ই বাইরের
গেট
খুলে
দেয়
তাকে।
ওই
সময়টুকুর
অপেক্ষায়
সারাদিন
অধীর
আগ্রহে
তাকিয়ে
থাকে
সে।
যেন
একঘণ্টার
মুক্তিটুকুর
জন্যই
বাঁচা
ওইটুকু
একরত্তিটার!
অনাবিল আনন্দে ছুটে বেড়ায় সম্পূর্ণা সারা পাড়া জুড়ে। নিজের মনেই এক্কাদোক্কা খেলে কাল্পনিক সব ছককাটা ঘরগুলোর উপর লাফিয়ে লাফিয়ে। সত্যিকারের জীবনে সঙ্গীসাথীবিহীন হওয়ার যন্ত্রণাকে ভোলায় কিছু মনগড়া ‘মিথ্যে মিথ্যে’ বন্ধু বানিয়ে, তাদের সাথে গল্প করে, হেসে। সাক্ষী শুধু তার সেই ভগবান চাচা। মেয়েটার ছোট ছোট কাণ্ডকারখানা কখনও সেই বৃদ্ধর মুখে হাসি ফোটায়, কখনও চোখ উপচে এনে দেয় কান্না। আহারে, এতটুকু মেয়েটা! সমবেদনার পাহাড় জমতে থাকে মনে, তবু কষ্ট লাঘবের উপায় কিছু জোটে না।
অনাবিল আনন্দে ছুটে বেড়ায় সম্পূর্ণা সারা পাড়া জুড়ে। নিজের মনেই এক্কাদোক্কা খেলে কাল্পনিক সব ছককাটা ঘরগুলোর উপর লাফিয়ে লাফিয়ে। সত্যিকারের জীবনে সঙ্গীসাথীবিহীন হওয়ার যন্ত্রণাকে ভোলায় কিছু মনগড়া ‘মিথ্যে মিথ্যে’ বন্ধু বানিয়ে, তাদের সাথে গল্প করে, হেসে। সাক্ষী শুধু তার সেই ভগবান চাচা। মেয়েটার ছোট ছোট কাণ্ডকারখানা কখনও সেই বৃদ্ধর মুখে হাসি ফোটায়, কখনও চোখ উপচে এনে দেয় কান্না। আহারে, এতটুকু মেয়েটা! সমবেদনার পাহাড় জমতে থাকে মনে, তবু কষ্ট লাঘবের উপায় কিছু জোটে না।
নজর অবশ্য অনেকেরই থাকে সম্পূর্ণার উপর। পুরোনোদিনের ছাপোষা পাড়া। লোকজনের কৌতূহল ঠেকানো কোনোভাবেই সম্ভব হয় না এসব জায়গায়। তার উপর সম্পূর্ণারা কারও সাথে তেমন মেশে না। ঔৎসুক্য এবং চর্চা তাই প্রায়ই চলতে থাকে বইকি তাদের নিয়ে। অবশ্য যথাযথ দূরত্ব বজায় রাখতেও কসুর করে না কেউ। বারান্দা বা কলপাড় থেকেই কেবল মুখ সামান্য বেঁকিয়ে পর্যবেক্ষণে মন দেয় অনেকে। বরং, ছোটরা অনেক বেশি আগ্রহী সম্পূর্ণার সাথে বন্ধুত্ব পাতাবার। তাদের তো আর বাধবিচারের বোধ থাকে না। তাদের সীমিত পরিসরের নিয়মগণ্ডির মধ্যে আটকা চরম ব্যস্ত জীবনে এই ছোট্ট মেয়েটি যেন পাখনা লাগিয়ে স্বাধীনতার পরশ মাখাতে চায়। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, এভাবেই তোয়াক্কা না করে বাঁচতে হয়, শুধুমাত্র ভালোভাবে বাঁচার দাবীতেই। যদিওবা তাদের মধ্যে কয়েকজন অবশ্য এগিয়ে আসে বন্ধুত্বের গোলাপী রঙ মেখে হাতে, তাদের মায়েদের নিষেধে বেশী দূর আর এগোনো হয়না কখনও বেচারীদের।
এসবে সম্পূর্ণার কিছু মনে হয় না আর আজকাল। সে বোঝে, পাঁচবছরের অবয়বের মধ্যে থাকা তার মানুষটা ইতিমধ্যেই বেশ পরিণত হয়ে উঠেছে অনেকগুলো ধেয়ে আসা ঝড়ঝাপটায়। ছোটখাটো দুঃখগুলো তাই আর আগের মতো ভাবায় না তাকে — মনখারাপের তেমন বড় কোনো কারণ হয়েও সামনে এসে দাঁড়ায় না। তার বেড়ে ওঠা বোধবুদ্ধিরা ধীরেসুস্থে যথেষ্টই বিচক্ষণ হয়ে উঠতে থাকে তরতর করে, তাদের খুলির আস্তরণ যেমনভাবেই সঙ্কুচিত করে রাখার ছদ্ম প্রচেষ্টা করে চলুক না কেন গোপনে কোনো অদেখা খলনায়কের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে।
বারান্দায় বসে সুনিধির নজরও অবশ্য আটকে থাকে তার একমাত্র মেয়ের উপর। এই ঘণ্টাখানেকের জন্যই হোক, সেও যেন শেকলভাঙা মুক্তবিহঙ্গ এক পরিযায়ী। যার কোনো চিন্তা নেই, জীবন চলার বা থামানোর তাগিদ নেই, যার ওড়ার ছন্দেই অনর্গল গান লিখে চলে স্বাধীনতা। বাকি সময়টুকু তো একটু একটু করে খালি হেরে যাওয়ার গল্পই বলে যায় জীবন। অন্তত, চব্বিশ ঘণ্টার নিরন্তর জিগ স’ পাজলের এই টুকরোটুকু তো হোক কিছুটা অন্যরকম!
অথচ এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না! সুনিধি বরাবরই উত্তাল দামাল প্রাণোচ্ছল এক প্রাণ। সকলের সঙ্গে হইহই করেই কেটে চলেছিল যার প্রতিটা মুহূর্ত; যেমনটা ঠিক ঘটে থাকে ঠিক রঙিন সিনেমার পর্দায়। সবচেয়ে দুঃখী নিপীড়িত মানুষটাও যার সংস্পর্শে এসে পেয়ে যেত ক্ষণিকের শান্তি, তার গল্পেও কি দুঃখ থাকে নাকি ঘাপটি মেরে! ওই সংবেদনশীলতার সুবাদেই তো একদিন স্বাভাবিক ছন্দে আবার ফিরে এসে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছিল সুচেতন, সুনিধির তৎকালীন স্বামীও। ‘তৎকালীন’, কারণ এখন সুনিধি স্বামী পরিত্যক্তা। সমাজের এক নিগূঢ় অন্ধকার গণ্ডিতে আবদ্ধ মৃতপ্রায় এক হারিয়ে যাওয়া প্রাণ!
ঘোর ভাঙে সুনিধির। দরজায় টোকা পড়ছে। দুপুরে খাওয়ার সময় হয়েছে। ভগবান তার ‘ছোটি দিদিমণি’কে তাই পৌছে দিতে এসেছে ঘরে। তাড়াতাড়ি সামলে নেয় নিজেকে সুনিধি। এক লহমায় ঝাঁপ মারে বর্তমানের দোরগোড়ায়।
“ভিতরে এসো পূর্ণ! রোদ লাগেনি তো বেশি?” দরজা খুলে মেয়েকে ভগবানের কোল থেকে নামাতে নামাতেই প্রশ্ন করে সুনিধি।
ভগবান একগাল হাসে। “ওটুকু রোদ লাগা ভালো! ওতে উনার কোনো ক্ষতি হবে না, তাই না ছোটি দিদিমণি?”
সম্পূর্ণা দুদিকে মাথা নাড়ে। “আমি তো দিব্যি আছি মা! এবার থেকে আরও কিছুক্ষণ খেলার অনুমতি দাও না মা আমায়! কথা দিচ্ছি, কোনোরকম দুষ্টুমি করব না। একঘণ্টা তো এক মিনিটের মতো দৌড়তে থাকে যে খালি, আমি তো কোনোভাবেই যেন তাকে ধরতে পারি না!”
সুনিধি
অসহায়
ভাবে
তাকায়
ভগবানের
দিকে।
অবিন্যস্ত
গোঁফের
ফাঁকে
আধখাওয়া
দাঁত
বার
করে
হাসে
দারোয়ান। “ভাববেন
না
দিদিমণি।
অত
ভাবলে
আপনি
যে
নিজেই
ভেঙে
পড়বেন
একেবারে।
ওদিকের
কোনো
খবর
নিলেন?”
সুনিধি ইশারায় তাকে দাঁড়াতে বলে কোলে তুলে নেয় সম্পূর্ণাকে। ভালো করে একবার দেখে নিয়ে যেন নিশ্চিন্ত হতে চায় নিজেই। আজ কি আর একটু স্ফীত লাগছে মেয়েটার মাথাটা? তবে কি আর বিশেষ সময় সত্যিই নেই হাতে?
নানা, এসব সে কি ভাবছে আবোলতাবোল? সেই না কাউন্সেলীংয়ের সময়ে উদ্বুদ্ধ করত তার পেশেণ্টদের, “জানবেন, জীবনটা কেবলমাত্র একটা লম্বা সড়ক ধরে দৌড়। সেটার শেষ মাথায় পৌছতেই যত হম্বিতম্বি! মাঝে থেকে যাওয়া হার জিতগুলো সবই সাময়িক — ওদেরকে বেশি প্রশ্রয় দিলে চলবে না”?
সেদিক
দিয়ে
দেখলে
অবশ্য
ঠিকই
আছে।
সুচেতন
তো
হিসাবমতো
ওরই
কথা
শুনেছে।
বিশেষ
জটিলতায়
না
গিয়ে
বলেছে, “বাকি
পথটুকু
একলা
বাঁচতে
দাও
আমায়! আমার
জীবনেও
যে
অমন
অভিশাপ
নেমেছিল
কোনোদিন, ভুলে
গিয়ে
আবার
এগোতে
চাই
শুধু, ব্যস।”
ঠিকই
তো! সুচেতনের
ক্ষমতা
ছিল না
কখনও
দায়িত্ব
গ্রহণ
করার।
সুনিধির
আগেই
এসব
বোঝা
উচিত
ছিল।
কাউকে
সারিয়ে
তোলা
যায়
না
কখনও, অন্তত
সে
নিজে
না
চাইলে।
“তুমি নিজের ঘরে গিয়ে স্নান করে নাও পূর্ণ। আমি তোমার চাচার সাথে একটু কথা বলে আসছি, কেমন?” মেয়ের কপালে চুম্বন এঁকে দেয় সুনিধি।
সম্পূর্ণাও মাকে পাল্টা ভালোবাসা মাখিয়ে কোল থেকে নেমে পরে। যাওয়ার আগে তার ভগবান চাচার হাত ধরে ফিসফিসানি করে যায় দুষ্টুমি ভরা চোখ মেরে, “উফ্, মা যে কবে বুঝবে আমি আর ছোটটি নেই! সব হয়েছে তোমার জন্য! এমন ছোটি ছোটি করো!”
ভগবান হাত বোলায় তার মাথায়, “এটুকু বোকা সব মায়েরাই হয়ে থাকে গো ছোটি দিদিমণি! ও নিয়ে ভেবো না। আর বাকি রইল আমার ডাক? বেশ, একটু বড় হয়ে যাও! তারপর দেখো আমিও কেমন তোমায় ‘বড়ি দিদি’ বলে ডাকি! হাহা! নাও, এবারে যাও বরং দেখি ভিতরে। বেলা যে অনেক হল!”
সম্পূর্ণা ভিতরে চলে যেতেই ঘরের পরিবেশ পাল্টে যায়। ভগবান চোখ রাখে সুনিধির চোখে। “কি বলল নতুন ডাক্তারবাবু?”
সুনিধির অভিব্যক্তি বিশেষ একটা পাল্টায় না। শুধু গলা কেঁপে ওঠে আবেগে। “অয়ন সত্যিই খুব বড় একজন নামকরা নিউরো সার্জন। তুমি ঠিকই খোঁজ দিয়েছিলে ভইয়া। ও বেশ কিছু পরীক্ষা করেছে। ওর মতে, বিরল হলেও সম্পূর্ণার কেসটা অজানা কিন্তু নয়। ডাক্তারী পরিভাষায় একে ‘ক্রেনিওসাইনোসটসিস’ বলে। সোজা করে বললে যার মানে দাঁড়ায়, মস্তিষ্ক নিজের বেড়ে ওঠার জায়গা পাচ্ছে না। ওর খুলি ইতিমধ্যেই পরিণতবয়স্ক মানুষদের মতো এমন শক্ত হয়ে গেছে যে তার মধ্যে আটকা পরে যাচ্ছে ওর ঘিলু। অথচ তাদের তো বৃদ্ধির সময় এখন! তাই চারধার দিয়ে হাঁকপাঁক করে বেরোতে চাইছে তারা, যার ফল ওই বেঢপ মাথা আর তার প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল বিকৃতি।”
ভগবান মন দিয়ে সব শুনল। তারপর ক্ষাণিক মাথা নেড়ে বলল, “অত তো আমি বুঝি না দিদিমণি! আমার বউয়ের হাত পা খুব কাঁপত ক’ বছর আগে। ওই ওনাকেই দেখিয়ে ও সেরে ওঠে। তাই ভাবলাম, ছোটি দিদিমণিকেও যদি উনি দেখে কোনো উপায় বাতলে দেন—”
হাসে সুনিধি। ম্লান হারিয়ে যাওয়া আবছায়া এক হাসি। “উপায় একটা আছে বটে। অস্ত্রোপচার। মাথার খুলিটাকে সামান্য চেঁচে কেটে বাদ দিলে মস্তিষ্ক আবার যথানিয়মে বেড়ে উঠবে। জটিলতা কিছু থাকবে হয়তো, বিশেষ করে অয়ন যা বললেন, আরও আগে এই অপারেশন করে নিলে তার সাফল্যের হার অনেকটাই বেশি ছিল। বিদেশে নাকি এমন আকছারই হচ্ছে। তবে —”
উৎসুক হয় ভগবান। চোখদুটো তার চিকচিক করে ওঠে আশায়। “তবে?”
“তবে তার জন্য টাকার প্রয়োজন। অনেক টাকা। পরিবার পরিজন সব ছেড়ে চলে এসেছি ভইয়া। তুমি তো সবটা জানো! বা বলা ভালো, মেয়ের অমন ভয়ঙ্কর ভাবে বেড়ে ওঠা মাথা দেখে সবাই নিজেরাই যোগাযোগ ছিন্ন করেছে আমাদের সাথে। আমিও কোনো উৎসাহ পাইনি কখনও ওদের বা নতুন করেও কারও সাথে সম্পর্ক স্থাপন করবার।” থম মেরে যায় সুনিধি নিজের ভাবনার অন্দরে ডুব দিয়ে। ভগবানের ঠোঁটেও কথা যোগায় না।
কিছুক্ষণ
পর
আবার
সুনিধিরই
কথা
শোনা
যায়
যেন
অনেক
দূর
থেকে। “এ কদিনে
তো
অনেক কিছুই
দেখলাম।
অতটুকু
শিশুকে
কেউ
বলেছে ‘শয়তানের
দূত’, কেউ
ভয়ে
শিউরে
উঠেছে, তো
কেউ
আবার
করেছে
হাসাহাসিও। বাইরের
লোকের
কথাই
বা
বলছি
কেন, ওর
নিজের
বাবাই
তো
ওকে
জন্মানোর
পর
দেখে, কি
বলব, এককথায়
পালিয়ে
গেছে! আর
যারা
সমবেদনার
মোড়ক
পরে
এগিয়েও
এসেছে, তাদেরও
তো
কেবল
শুনি
অন্য
চিন্তা
সবসময়। ‘ও বাবা, ও
মেয়ের
বিয়ে
দেবে
কি করে?’ ভাবো
ভইয়া, মেয়েটা
আমার
বাঁচবে
কিনা
ঠিক
নেই, আর
ওদের
যত
আজগুবি
চিন্তা
ওর
ভবিষ্যৎ
নিয়ে! যেন
অন্যের
ঘরে
বউ
হয়ে
যাওয়াটাই
একটা
মেয়ের
জীবনের
সাফল্যের
একমাত্র
মাইলফলক!” আর
পারে না
সুনিধি।
সব
দুঃখ
বাঁধ
ভেঙে
ভাসিয়ে
দেয়
তাকে।
ভগবান মাথায় হাত রাখে ক্রন্দনরতা সুনিধির। তার তো কিছুই অজানা নয়।এপাড়ায় আসার পর কে একজন তো গুণীন পর্যন্ত পাঠিয়ে দিয়েছিল তার ছোটি দিদিমণির শরীরে কোন জিন বাসা বেঁধেছে পরীক্ষা করার জন্য! সে মেরে না তাড়ালে কি যে ভোগান্তি পোহাতে হতো বেচারীকে, ভাবলেই এখনও শিউরে ওঠে সে।
সোসাইটির
একজন
বাচ্চার
বাবা
তো
সরাসরি
তার
সামনেই
প্রশ্ন
করেছিল
সুনিধিকে, “কি
কি
ঠিক
খেয়েছিলেন
বলুনতো
আপনারা
যে
অমন
কিম্ভুতকিমাকার
মেয়ে
জন্মালো
আপনাদের
ঘরে? কোনো
ভূলভাল
গর্ভপাতের
ওষুধ
টোষুধ, কি
তাইতো!”
আবার এই তো সেদিন দুপুরের ঘটনা, এক মা চিৎকার করে তার ছেলেকে সাবধানও করেছিল সব্বাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে, “ওর দিকে যাসনা খোকা। কি জানে কি রোগ আছে ওর! যদি ওর ছোঁয়া লেগে যায় তোর! ইশ!”
ওই ‘ইশ’ টা এখনও কানে বাজে ভগবানের। লোকে ভূলে যায় কি করে অন্যকে ছোট করার আগে যে তারাও মানুষ? তাদেরও সুখ দুঃখ আছে, তাদের অন্তঃস্থলেও অগ্ন্যুত্পাত হয়, বেদনা ঝরে পরে? তবে কি জীবন বলে আর কিছু নেই কোথাও? বাঁচার সমস্ত আশাটুকুও হারিয়ে গেছে রণক্লান্ত হয়ে? কি মানে এরপরও স্বপ্ন দেখার? ভরসা করে আবার সামনে আরেক পা ফেলার?
শুধু
বাঁচতে
চাওয়ারই
এ কেমন
ভয়ানক
পরিণতি?
স্নান ঘর থেকে জলের আওয়াজ আসে। সম্পূর্ণা ছপাত্ ছপাত্ করে স্নান করছে মহা উৎসাহে। তার উদাত্ত কণ্ঠ গেয়ে উঠল হঠাৎ তার নিজের মতো করে সকালে রেডিওয়ে শোনা গান। “ও জীবন রে! ও জীবন, ছাড়িয়া যাসনে মোরে—”
তারপরেই দুরকম গলা করে শুরু হল তার নিজস্ব মিথ্যে মিথ্যে বন্ধু মহলের কথোপকথন।
- “কেন ছেড়ে যাবো না শুনি তোকে? তুই তো পচা, তোর হাঁড়ির মতো মাথা!”
- “হিহি, তা হাঁড়িই তো, কলসি তো আর নয়! হাঁড়ি জানিস কত্ত কাজে লাগে? হাঁড়িতে ভাত রাঁধা যাবে, আলু পটল সব সেদ্ধ দেওয়া যাবে! আমার মা কেমন সুন্দর ভাত রাঁধে ওই হাঁড়িতে জানিস! আহ! ভাতের সুবাসে ম ম করে তখন চারদিক! আমার তো ওই গন্ধেই খিদে পায়! অথচ, হাঁড়িটা কিন্তু বিচ্ছিরি দেখতে, কয়েক জায়গায় কালচে মেরে তুবড়ে গিয়ে, উফ্, একেবারে বিভৎস অবস্থা!”
- “তার মানে ঠিক তোর মাথার মতো! তাই তো! এই এই! ওতে কিন্তু বেশ ঢোল বাজানো যাবে! ‘আহা টাকডুম টাকডুম!’
-“ হ্যাঁ হ্যাঁ। সত্যি তো! আর কারও তো এমন সুযোগ নেই! ‘আহা টাকডুম টাকডুম বাজে”
-“হাঁড়িমাথার ঢোল! হি হি!”
-“হি হি! সত্যি মা, ভগবান চাচা এরা যে কি বোকা! খালি কাঁদে আমার কথা ভেবে! কাঁদলে চলে বল! এ জীবনটাকে ঘরের কোণে আটকে বেঁধে কি আর রোখা যায়, তার চেয়ে হেসে খেলে হইহই করে বাঁচতে হয় তো! খেলতে হয়, লাফাতে হয়!”
-“আর কেউ মুখ ভেঙালে?”
-“আরও বাজে করে তাকেও দুগুণ ভেঙচি কাটতে হয়! উউউ! হি হি!”
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো পাথরমূর্তি সোনার কাঠির পরশে হঠাৎ স্থবিরতা মুক্ত হয়ে প্রাণ ফিরে পায় ভরদুপুরবেলায় । হো হো করে হেসে ওঠে তারা এক্ষুণি চুরি করে শিখে ফেলা নতুন উদ্দীপনায়। একে অপরের দিকে তাকিয়ে বয়স, স্থান, কাল, পাত্র ভূলে একসঙ্গে দুজনেই জিভ ভেঙায় স্নানঘরের বাচ্চা মেয়েটার দ্যোতনায়— “উ--উ--উ---”
*************************************
Parijat
Patuli Natun para, Garia,
Kolkata
Currently residing at Sydney, Australia
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন