Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

নবপ্রভাত ব্লগের জন্য কবি বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতার আলোচনা জুবিন ঘোষের কলমে




“৬০

     ৫৯

৫৮


তিন সেকেন্ড হয়ে গেল দাঁড়িয়ে আছি এই পৃথিবীতে

শোক যেখানে উপলক্ষ্য

আর নীরবতা পালন শুধুমাত্র কথা বলার মহড়া...

কথা নিজে তবে কীসের রিহার্সাল—

সব মোক্ষণের, সকল আবেগমুক্তির”


‘ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে’ চলে যাচ্ছেন কবি বিনায়ক । আমাদের প্রিয় কবি বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় । আজ থেকে দুই দশক আগে এই কবি বিনায়কই  যাত্রা শুরু করেছিলেন সেই নব্বই শুরুর দিকে। আজও তিনি যাচ্ছেন । আমাদের সামনে দিয়েই যাচ্ছেন । পার্থক্য শুধু এটাই আজ যাচ্ছেন পথের দুপাশের ফুলের স্পর্শ পেতে পেতে । আজও যাচ্ছেন অথচ আমরা সবাই বিহ্বল । নব্বই এর দশকে সেদিন ছিল আনন্দের যাত্রা । এক কবির হয়ে ওঠার যাত্রা । আজ কবির হয়ে থাকার যাত্রা । কবির যাত্রা পথের অনুষঙ্গে রয়েছে চরম উপলব্ধির লৌকিক প্রকাশ - তার সত্যান্বেষণের স্পর্শ থেকে দূরে নিষ্ঠার উপাচার - সমস্ত সব ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াশীল বৃত্ত ! পরম পাওয়ার কাছে উপনীত হওয়ার সাঁকো তৈরির মাঝে সেই সব অপূর্ব সৃষ্টির নিদর্শন রাখতে রাখতে দিনগত অলৌকিক জীবন প্রবেশ করছেন বিলাসী পরিব্রাজকের মত... যাত্রিক কবির পরম সত্যের সাধনার মর্মস্পর্শী মূল্য রূপে অসংখ্য অবাক চোখ  এতদিন তার মুদ্রিত  সার্থক প্রয়াস দেখে আনন্দিত হয়েছে, আশ্চর্য হয়েছে  বিনোদনের বস্তু মনে করে,  এখন  উপলব্ধির পথে শিল্পীর জীবনের চরম এক যাত্রা । আমরা নীরব দর্শক ফুল নিয়ে অপেক্ষা করে আছি সেই সব পথে , মোড়ের মাথায়, কবির যাত্রা পথকে দেখবো বলে । "সময় হয়েছে দেখো সময় হয়েছে / কেন সমস্ত সময় হয় না আপামরে ভালবাসা ?" তার শেষ দুটি লাইন  কি এই সময়টারই প্রবাদ প্রতিম উপলব্ধির অন্তিমে নিয়ে গেছিল? – এই যাত্রা মানস দর্শনে দেখেই তো  বৃত্ত সম্পূর্ণ করে তার লেখনী বলে উঠেছিল --“এইমাত্র শেষ হল, মৃত্যুর উদ্দেশে চোখ নামিয়ে রাখা.../ আমি বেঁচে আছি । বেঁচে আছি আমরা।”

#

আমি বিনায়ক দার ভাই । অনেক অদ্ভুত ব্যক্তিগত  সময় কাটিয়েছি তার সঙ্গে । কাছ থেকে দেখেছি সেই কবিকে । কবি হয়ে ওঠাকে । তাই এই যাত্রাকেই আবিষ্কার করা হবে এই লেখায় তার প্রতি আমার অঞ্জলি । এই যাত্রাকে কি কবি মানস চক্ষে দেখতেন ? কী দেখতেন কীভাবে দেখতেন সেই আঙ্গেলই হবে এই লেখার অবয়বে কবির প্রাণ প্রতিষ্ঠা । এই শোভাযাত্রাকে দেখতে দেখতে আনন্দচোখের বিস্ময় মুগ্ধতা । যা হয়ত প্রকৃতই চেয়েছে কবি বিনায়ক । কীভাবে দেখেছেন কবি মৃত্যুকে , কীভাবে দেখেছেন এতদিন নিজের বেঁচে থাকাকে । বিনায়ক’দার কবিতাতেই খুঁজে যাব এই যাত্রাকে ।

#

রবীন্দ্রসদনে এসে গেছেন তিনি । তিনি নামছেন । আজও সেইরকম ভিড় যেরকম তিনি যেখানেই যান তাকে ঘিরে থাকে । আজ যেন সেভাবেই ভালবাসার জোয়ারে ভেসে যেতে যেতে উজানবাহী কবির সঙ্গে যারই  দেখা হচ্ছে যেন স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তিনি আলিঙ্গন করে নিচ্ছেন তাদের । “তারপরই তো ভেসে যাব / গত এবং আগামীতে / আজকে কিছু দিয়ো না আর আজ এসেছি ফিরিয়ে দিতে”(ভুঁইচাপা) --এতদিন তিনি তো প্রায় মন পড়ে নিতেন  সেইসব খেটে খাওয়া মানুষদের যারা সেই ভাটার চরে জীবনের  নির্বেদ ক্রিয়া স্বপ্ন শিকার করে, যেখানে দেহোপজীবিনীর ধূসর হৃদয় প্রেমহীন রতির মাঝেও অকাতর ভিক্ষা করে ভালবাসার অনাময় বর্ষণ... মনের কিনারা ছুঁয়ে যায় ভালবাসার জল –   আজ সেই অমৃত স্পর্শেই সিক্ত হতে হতে তিনি চলেছেন  মনের উপান্তে ধূসর প্রান্তর এখনও যেন তিনি সেই আমরণ যাত্রিক; ঠিক যেন তার কাব্যগ্রন্থ –“রিক্সা নয়ত রূপকথা” এর মত তার এই যাত্রাপথকে ঘিরেও মিথ তৈরি হবে রূপকথা যেমন হয় ।

#

এই বিনায়কদাই একবার বেঁচে থাকার কার্যকারণ খুঁজতে খুঁজতে এক অদ্ভুত উপমায় প্রকাশ করেছিলেন তার  লৌকিক জীবনের অসারতাকে -

“কেন তুলে আনলাম না সংযুক্তাকে

কেন ছেড়ে আসলাম না বিষ্ণুপ্রিয়াকে

কেন বেঁচে ছিলাম

কেন বেঁচে থাকব –

আলোর গায়ে শ্যামাপোকার মত ?

বোতলের গায়ে জেলির মত ?

শুধু একবার সুযোগ পাওয়ামাত্র –

প্রসেনজিৎকে - ‘বুম্বাদা’ আর

অপর্ণা সেনকে – ‘রিনাদি’ বলে ডাকার জন্য ?”

"কেন বেঁচে থাকব – / আলোর গায়ে শ্যামাপোকার মত ? / বোতলের গায়ে জেলির মত?" প্রাণহীন স্বচ্ছ কাচের গায়ে লোলুপ প্রবৃত্তি তাড়িত বিকৃত কেজো মনের জেলির উদ্দেশ্যহীন মনুষ্যত্বর অস্তিত্বের অসারতাকে শ্লেষের সঙ্গে প্রকাশ করেছিলেন কবি । বোতলের প্রসঙ্গ টেনে আনে যেন তেন প্রকারেণ প্রবৃত্তি সিদ্ধির ক্লেদাক্ত অর্ধ-চেতনে এককালীন হৃদয়হীন ছুটে যাওয়া যা লৌকিক জীবনের কেন্দ্রে অবস্থান করে... নিঃশ্বাস বন্ধ করা বোতল-বন্দী উপস্থিতি যা কিনা  উদ্দেশ্যহীন, তমগুণ সম্বলিত, অসারতার নামান্তর। “কিন্তু কোনটা ঠিক না ভুল সে বিচার করবে / সাধ্য কী তার , হয়তো আমি নিজেই তখন / পাতাল রেলের দৌড়ে আসা চাকার সঙ্গে / লিপ্ত হবার পাগলা নেশায় ঝাঁপ দিয়েছি” – কবি কী ভয়াভয় মৃত্যুকে কয়েকমুহূর্ত উপলব্ধি করেছিলেন নইলে এই কথা কীভাবে লিখলেন ? সৌন্দর্যের - সত্যের - ভালবাসার এমনই মুগ্ধতা, যেখানে সমস্ত সব প্রয়াস পাপপূন্যহীন... একমাত্র যাত্রার অন্তে সেই পরমের খোঁজে নিবেদিত হৃদয় সম্পূর্ণ সমাহিত অবস্থায় নিরন্তর খুঁজে চলে প্রবাদ স্পর্শ! সত্যের পথে... সাধনার শীর্ষে আসীন কবির বৃহত্তর যাত্রায় অন্তিম বিন্দুতে লীন হয়ে যাওয়ার তৃষা হয়ে ওঠে জীবনব্যাপী প্রয়াসের মূল আকর। যেমন আগেও খুঁজে চলেছেন তেমন যেন এই বার তার বিশাল বিস্তৃর্ণ পাঠকেরা তার কবিতায় খুঁজে চলবেন সেই সব মহার্ঘ্য দর্শন ।

#

আমরা যখন বিনায়কদার কবিতা পড়েছি আর আজ যখন ‘ভুঁইচাপা’ কবিতাটা পড়ছি আর তার সঙ্গে  মিলিয়ে দেখছি বহু আগেই কবি স্বপ্ন প্রকাশের শব্দগুলো অদ্ভুত এক কল্পনা আর সত্যের মিশেলে তৈরী করে দিয়ে গেছেন । এই কবিতাতেই তিনি লিখেছেন - “সিল্কে বোনা রাতের আকাশ/চরকা কেটে তৈরী মাটি/বিশালাক্ষী অন্ধকারে/দুলতে থাকা ভুঁইচাপাটি” সত্যিই যেন চরকা কেটে বেরুচ্ছে চিত্রকল্পের সিল্ক কালো রাতের রুমাল আকাশ আর বিশালাক্ষ অন্ধকারে হলুদ চাঁদের অসহায়তা নিয়ে কবির অনন্ত আত্মদর্শন ! "বিশালাক্ষী অন্ধকারে" এই ব্যঞ্জনাময় কথাটির আর কি বিশ্লেষণ হয় ?  কবি বিনায়ক রয়েছেন । রাত বাড়ছে । তাঁর পাশে দুলে উঠছে ফুলের সারি । রবিন্দ্রসদনের সমস্ত ফুল এখন তাঁকে ঘিরেই । এই ফুলগুলো এক একজন তরুণ কবি । এখন যেন এই সবই সেই “বিশালাক্ষী অন্ধকারে/দুলতে থাকা ভুঁইচাপাটি”এর মতই লাগছে । সবই না বলা কথার অনুষঙ্গে, হলুদ চাঁদের মত, রুমাল আকাশের মত অনুচ্চারেও স্পষ্ট অনুভবের কেন্দ্রে অবস্থিত! এবারে " দুলতে থাকা ভুঁইচাপাটি" মাটির সাথে অনায়াস সাঁদ করে নিতে পারে বিদগ্ধ পাঠক মন... জৈবনিক দিনগত বিশ্বাস যেন অবিশ্বাসী দুঃস্বপ্নের মত চাপা পড়া চেতনাকে প্রলেপের অন্তরালেও স্পর্শ করে অকাতর... সেই ভালবাসার ছন্দের চরাচর পাড় ভাঙে-গড়ে কবির মননে, উপলব্ধ সত্যের প্রমত্ততায় সমৃদ্ধ হন কবি, সেই দোলা লাগে চলাচলে... বেঁচে থাকার দৈনন্দিন তাড়নাতেও দুলে ওঠে । কবি তো বেঁচে থাকতেই চেয়েছেন সবার মাঝে । কিন্তু তারই মাঝে তাঁর মনন দর্শন করেছে সেই "বিশালাক্ষী অন্ধকার”কেও । আরও একবার পড়লাম তোমার কবিতাটা বিনায়ক’দা । আরও একবার দেখলাম । তুমি কি জানতে পারছ সে সব কথা ? “শিকড়ে তার চাঁদের রক্ত / চাঁদ কীভাবে ফুটবে টবে ? / হৃদমাঝারে ধারণ করো / তোমায় নিয়েই ধ্বংস হবে ।”--'চাঁদের রক্ত' শিকর জুড়ে... যেন বহুদূর থেকে শঙ্খধ্বনির মত ভেসে আসে প্রাকৃত সত্যতার আবহ বাণী – এখন তো শঙ্খই শ্রেয় । অমেয় এই শিল্পের সুষমা - প্রকৃত সুন্দর চলাচলে, রক্তধারায়... উদ্ভিদের রসগ্রাহী খাদ্যনালীতে। স্বপ্নাদেশে আবিষ্ট কবিচেতনা তাই বলে ওঠেছিল - "চাঁদ কীভাবে ফুটবে টবে?" এখানেও কবির সেই একান্ত শিল্পচেতনা প্রকাশ পেয়েছিল, যেখানে শিল্প অধরা - অলীক নয়, দেহমন দিয়ে সাকার প্রেমের মূর্ত প্রিয়া... বুকে ধারণ করা সাক্ষাত দেবীর প্রতিভাস! মহাশক্তির মূর্তিমতী প্রতিষ্ঠিত রূপ আবার শাশ্বত সখ্যতায় সমাদৃত জীবনের অংশীদার... এই অনন্য দ্বিজত্বে চিত্রময় অনুভব আরো সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে, অচিরাৎ চলে আসে মরণশীল মানুষের উপলব্ধির উপান্তে...

#

এ যেন তাঁকে তাঁর কবিতাতেই খুঁজে চলা । এর বেশি কিবা করতে পারি আমি ? “তোমার যে পায়ে চুমু খেয়েছি/সে পায়ে শুধু নূপুর ছিল কি ?/ছিল না ব্যান্ড-এইড ?” –‘চোরকাঁটা’ কবিতায় আমরা দেখতে পাচ্ছি ভাবময়তা যখন শীর্ষ ছুঁয়ে যায় তখন অনেকসময় এমন ভাব সম্বলিত লেখায় প্রকাশের পরিধি ক্রমশ ছোট হয়ে আসে, পরিবর্তে গুরুত্ব পায় ভাবের মূলে শব্দাতীত যে বিশ্বাস রয়েছে তার নিজস্ব বিস্তার... এমনধারা নিখাদ manifesto কেন্দ্রিক প্রকাশ শিল্পের নিদর্শন ছাড়া অনুপদ্যের ভাববৃত্ত অধরা থেকে যায়। এখানেও কবি প্রকাশ করেছেন সেই মূল বিশ্বাস - 'তুমি' শব্দ বাহক হিসেবে ব্যবহার করে তিনটি পদেই ছুঁয়ে দিয়েছেন চিরায়ত ভালবাসার প্রতিটি উৎসমুখ - সুখে দুঃখে তার মানস প্রিয়াকে কামনা করেন তিনি - হতে পারে সে শিল্প কিম্বা নারী - হতে পারে সে পূর্বাপর বা নিছক মুহূর্ত কোনও, কিংবা সুখস্মৃতি, তবু একাঙ্গে তাকে আহ্বান করেন কবি... রোমন্থনে মনে করিয়ে দেন মানস প্রিয়াকে সেই দ্বিজত্বের চলাচল...

#

‘শর্ত’ নামক কবিতার দিকে যখন তাকাই দেখতে পাই --“তবুও এই হৃদয় , তুমি / মিথ্যে যাকে ভোমরা ভাবো / আমি তো তাকে লুকইনি গো / আস্থিনেই রেখেছি মেলে / খবরদার গোটাতে বলবে না” – যেন এই কবিতায় কবি চলেছেন হৃদয় বিশ্ব-ভুবনে - হৃদয় চলেছে মৃগয়ায় - সারি বাঁধা ঘর প্রপাতে ভেঙেছে - প্রহর ভেঙ্গেছে সীমানায় - অসাধারণ ভাবকল্পের প্রকাশে প্রবল আত্মশক্তিতে কবি সোচ্চারে বলে ওঠেন তার নিয়ত সাধনপথের অপার ব্যাপ্তির কথাই লিখে যাচ্ছেন – "মিথ্যে যাকে ভোমরা ভাব /আমি তো তাকে লুকোইনি গো" এখানে বিনায়ক নিজেকে মেলে ধরেন বিশ্বময় অভিকর্ষের উন্মুখ প্রবেশদ্বারে। ভিতর বাহির একাকার হয়ে যায় চেতন অবচেতনের সময়াতীত মিলনে - তার হাত থেকে বিশ্ব চরাচরে ছড়িয়ে পরেছে অনাময় ভালবাসার বীজ! সেই আগামীর সবুজের লক্ষ্যে একনিষ্ঠ যাত্রা তার বহুমুখে... প্রতিটি পথে - সর্বাংশে - একইসাথে বিশ্বভুবনে মেলে ধরেন নিজেকে। জীবনের জয়গানে সদা প্রকাশিত - একাকী দাঁড়ান গিয়ে মহাসিন্ধুর সম্মুখে! বিনায়ক নামক সেই মহাসিন্ধুর সামনেই এখন আমরা সবাই দাঁড়িয়ে ।

#

কবি বিনায়ক ভালবাসার প্রতীক যেন । সমস্ত তরুণ কবিদের বুকের সঙ্গে বেঁধে রাখতে জানেন । তাঁর কাছে গিয়ে আমি বহুবার এমন উপকৃত হয়েছি সেই কথা বলে বোঝানোর নয় । ভাল বাসতে জানেন কবি । তাই ভালবাসার মৃত্যুকেও ভয় পান । কবির অসংখ্য প্রেমের কবিতায় ভালবাসাকে উচ্চারণ করছেন তীব্র অভিমানে । সেই অভিমানকেও যেন আজ সঙ্গী করেছেন তিনি ।  “বৃত্ত যেমন নিজের বুকের শূন্যতাকে বাঁচিয়ে রাখে / আইপড আর সিডির ভিড়েও সরস্বতী বাঁচান বীণা / আমি তোমায় বলতে চাইছি , ভালবাসা মরার পরও /সার্কাসে এক নতুন জন্তু এসেছে তার নাম জানি না” –‘ভালবাসা মরার পরও’ কবিতায় উপহাসের মধ্যে দিয়ে কবি অভাবনীয় মমতায় সেই ভালবাসার মৃত্যু তারিখের হদিশ সংকেত রেখেছিলেন  পাঠকের কাছে। সমস্ত ধ্বংসের পরও বেঁচে থাকে ভালবাসা... হোক না বিধ্বংসী যেটুকু মনুষ্য অবশেষ বাকী রয়েছে তার স্পর্শ থেকে দূরে - হোক না কোন দুই পয়সার তামাশায় মনুষ্যতর জন্তুর বিকৃত প্রকাশের মধ্যে প্রচ্ছন্ন হারানো লালিত্যে - তবু নিত্য নৈমিত্তিক আগ্রাসনে ভালবাসার ওমে আবদ্ধ থাকে সব পেয়েছির শান্ত শূন্যতা! সংরক্ষিত থাকে প্রাচীন প্রবাদের মত ভালবাসার বিমূর্ত বিশ্বাসটুকু... । ‘ভালবাসা মরার পরও’ কবিতায় তিনি লিখেছেন –“গায়ে যতই আলো থাকুক ধাতুর ভিতর শুধুই ধাতু / তোমার দেওয়া আংটি খুলে চেষ্টা করি তোমায় পাবার” --এখানেও সেই নিখাদ ভালবাসার অতল তলের খোঁজে এককালীন খনন করেছিলেন কবি... "গায়ে যতই আলো থাকুক ধাতুর ভিতর শুধুই ধাতু" ব্রতচারে প্রশ্নহীন ভালবাসার স্পর্শ তৃষায় উন্মুখ মননে সমস্ত অন্ধকার ধারণ করেন নিজেরই শরীরে... নেমে যান লোকাচারের বৃত্ত থেকে অনেক দূরে - ভয়ঙ্কর সুন্দরের খোঁজে এখানেও একক যাত্রী তিনি। অদ্ভুত দ্বিমাত্রিক ব্যঞ্জনা এনেছে প্রথম পদের ঐ 'ধাতু' শব্দটি - ধাতু অর্থে নিরেট, নিপাট, প্রাণহীন অলঙ্কার যা কিনা প্রাকৃত সত্যতাকে ঢেকে রাখে কৃত্রিম আলোকে - আবার আরেকটু ভিন্নতর মাত্রায় ঐ একই শব্দ মানুষের দিনগত অস্তিত্বের প্রবৃত্তিগত আপাতঃ চেতনের নামান্তর। অলঙ্কারবিহীন সেই আকরের সত্যান্বেষণে নিয়ত কবি বলে ওঠেন - "তোমার দেওয়া আংটি খুলে চেষ্টা করি তোমায় পাবার" । তাই আজও তাঁকে ঘিরে এই ভিড় এই ঘিরে থাকা ।

#

ভালবাসা ও প্রেম অঙ্গাঙ্গীভাবে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিনায়কদাকে কবিতার অসংখ্য অমেয় পঙক্তি দিয়ে গেছে । কবি সেই আদির পিতা ইব্রাহীমের মত সত্য সুন্দরের প্রান্তরের খোঁজে শুরু করেছেন মানস যাত্রা - তার সাধনার আধারের অনুসন্ধানে এককালীন যাত্রিক তিনি... কৃত অভিজ্ঞতা - অতিক্রমের প্রয়াস এনেছে ঘাম, পায়ের পাতায় জলের স্পর্শে চমক ভাঙ্গে তার, যাপন জুড়ে সার্থকতার খাল বিল নদ পেরিয়ে, মানুষের বসত ছেড়ে, নির্জন নিরালায় দূর্গম বনপথ পেরিয়ে উপলব্ধির কিনারে এসে দাঁড়ান তিনি - "খাদের সেই কিনারা যাকে ‘ধারণা’ বলে লোক" এই কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে ভালবাসার প্রচ্ছন্ন প্রবাদটুকুর সন্ধানে সম্পূর্ণ জীবন যাত্রার সত্যতা..

#

প্রত্যেক মানুষকে বুকে ধরার এক অদ্ভুত ক্ষমতা কবি বিনায়কের । তাই তো তিনি তাঁর কবিতায় সেই মাটির সঙ্গে পা রেখে চলতে চলতে বলতে পারেন---“আমি তো তার মতই রে ভাই / নিজের রক্তে নিজে আঁচাই / ডাকলে বলি মুখটা মুছে আসি " । ভাবুন আন্তরিক সেই ডাক । সেই ভাবনা যা কিনা একজন বড় মানুষই বলতে পারেন । এই কবিতায় যখন তিনি বলছেন-- "ডাকলে বলি মুখটা মুছে আসি"... কিন্তু এটুকুই কি শুধু? উপমার চরম শীর্ষে কবি চলে যান এবং উপজীব্যে তুলে ধরেন মানুষের চিরায়ত ভিতর বাহিরের রূপ... প্রথম ও শেষ পদে দেখি সেই সাধারণ সত্যতা একমাত্র শ্লেষের আঘাতস্পৃষ্ট অকপট প্রকাশ। কিন্তু মধ্যাবর্তে অর্থাৎ মাঝের অমোঘ পদটিতে মনুষ্যাতীত সত্যের আকর প্রোথিত রয়েছে - " নিজের রক্তে নিজে আঁচাই" একেবারে শ্লেষের চরমে সত্যের আবেশ - মানবিক চেতনায় অবিশ্বাস্য দেবত্ব বোধ! চরম সত্য... নিজের রক্তেই দুয়ে দিয়েছেন কলঙ্কিত মানুষের রক্তের জঞ্জাল... মানুষের শুদ্ধাচারে নিবেদিন করেছেন নিজেরই রুধির! এ যেন সেই মানবিক প্রবৃত্তির সীমানা ভেঙ্গে সত্যের অভিমুখে তার একক যাত্রার সংকেত।

#

প্রেমের মাঝেও কোথাও কি সেই মৃত্যু চেতনাটা ছিলোই ? নইলে কী করে লেখেন –“ছিলাম ব্যাঙ হয়েছি রাজপুত্র / এবার তবে পক্ষীরাজে চেপে / ঘুরে বেড়াব শহরে , খোলা মাঠে / গন্ধ হয়ে ভাসব চন্দনে / # / আমারা বাদে আমরা আছি যত /সবাই আজ হয়েছি রাজপুত্র / ছিলাম ব্যাঙ হয়েছি রাজপুত্র / সে তো কেবল তোমার চুম্বনে” ।  ‘সে তো কেবল তোমার চুম্বনে’ কবিতায় পাঠক লক্ষ করুন কবি লিখছেন “গন্ধ হয়ে ভাসব চন্দনে” । এইভাবেই শিল্পের সেই প্রবাদ স্পর্শ মুগ্ধতা এনেছে কবির লেখনী নিঃসৃত চরণে... কোন্‌ সে অকিঞ্চিৎকর উপস্থিতির তন্তুজাল কেটে বেরিয়ে এসেছেন তিনি? সে তো আদি অনাদির চিরায়ত ভালবাসার অমরতায় পুনর্জীবন লাভ করেছেন তিনি! এ সেই হৃদয়ের প্রান্তরে ছন্দের দুন্দুভি - উপলব্ধ জৈবনিক সত্যতায় শঙ্খে বাদ্যে অভিষেক হয়েছে তার! স্থান কাল নির্বিশেষে সেই গোপন ডানায় ভর করে  কল্পলোকে উড়ান দিয়েছেন অভিনব মুক্তির অমৃত আস্বাদনে যেখানে সবাই সেই প্রবাদ স্পর্শে লাভ করেছে সার্বিক অমরতা - সত্যের প্রহরে অমেয় প্রেম এসে উজ্জীবনের চুম্বন দিয়েছে তাকে - এই অনৈসর্গিক রূপান্তর যেন পারস্যের কোন এক সুন্দরী লবেজানের উদ্দেশ্যে বৃদ্ধ দরবেশের আর্তি - "শুধু একটিবার চুম্বন দাও - আবার আমি জোওয়ান হব”। অথচ সব শেষে ‘সে তো কেবল তোমার চুম্বনে’ কবিতায় তিনি কিন্তু লিখছেন—“ভাল তো বেসেছি , ভালবাসবই কথার উর্ধ্বে উঠে” । মাত্র দুটি পদে আত্মযাত্রায় উপলব্ধ চরম সত্যতা প্রকাশ করেছেন কবি - তার ভালবাসার গভীর তৃষা - তার সাধনার প্রতি নিবেদিত হৃদয় পরম প্রাপ্তির বিশ্বাসে অটল... সত্যান্বেষণে নিবেদিত জৈবনিক যাত্রার শেষে একমাত্র সেই প্রসাদ স্পর্শ পেতে চান তিনি, চেতনার অন্তিমে একক বিন্দুতে বিলীন হতে চান মোক্ষ শেষে! পথে অন্য অন্য সমস্ত প্রাপ্তিকে নির্বিচারে অগ্রাহ্য করে নির্লোভ তদগত কবি এগিয়ে যাচ্ছেন বীণাপাণী সরস্বতীর পায়ের দিকে ‘ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে’

#

 “আনছ তুমি এবং দামি পর্দা টানা / ঠান্ডা ঘরে সব হারিয়ে , বান্ধবীকে /এস টি ডি - তে জানিয়ে দিচ্ছ , ‘সব পেয়েছি ’”--এই লেখাটিও সেই বস্তুবাদের অনাবশ্যকতাকেই তুলে ধরেছে... কবি তাই জৈবনিক কিছু অনুষঙ্গে তুলে ধরেছেন লৌকিক বৃত্তে এই সব পাওয়াটুকুর অসারতাকে... সব পেয়েছির দেশে সবটুকু না পাওয়ার যন্ত্রণাও একদিন ফুটে উঠেছিল কবির কলমে । এটি একটি অদ্ভুত লাইন যার ভাব বিস্তার অমেয় - কোন্‌ সে সত্য পর্দা টেনে আড়াল করছে ভ্রান্ত অজ্ঞাত জীবন... কোন্‌ সে ঠান্ডা ঘরের শীততাপনিয়ন্ত্রিত কৃত্রিমতা পথ রুদ্ধ করেছে আগ্রাসী হাওয়ার... কবি তাই পাঠকের সামনে নিরর্থক কৃত্রিম উপাদানগুলো তুলে ধরতে চান - সেই অসারতা যেখানে প্রিয়া থাকে না স্পর্শের সীমানায় - দূরভাষের বৈদ্যুতীন তরঙ্গে পাওয়া যেতে পারে তাকে - বড় ভয়ঙ্কর সেই অবস্থার কথা বলেন কবি - যখন সমস্ত সব প্রবাদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে - জীবন তার প্রকৃত উপাদান নিয়ে ক্রমশ তলিয়ে যাছে কালের অলক্ষ্যে!

#

আসলে তিনি যাচ্ছেন । আভ্যন্তরীণ উপলব্ধ সত্য সুন্দরের কড়ি হাতে দাঁড়াতে চান প্রকাশ মহিমার বৈতরণীর সামনে একা প্রকৃত সমাজদর্শন এবং প্রবাদের মত ভালবাসার বিমূর্ত বিশ্বাসটুকু সঙ্গে নিয়ে। পুনরুজ্জীবনের  গর্ভ থেকেই জন্ম নেয় আমার এই লেখা ... বেঁচে থাকার প্রতিযোগী ইচ্ছেসকল - পূর্ণগ্রাসী প্রকৃতির মাঝে অকিঞ্চিৎকর উপস্থিতির জন্য কালান্তর তৃষা - প্রকৃতির এই তৃণদপি উপস্থিতির শক্তিও অমেয়... সহাবস্থানে বেঁচে থাকার পবিত্র সত্যতা মূর্ত হয়ে ওঠে এই লেখায়। বিনায়ক’দার ঝুমঝুমি কবিতার পঙক্তিতেই তাকে বলে  উঠব – “আমিও খুঁজি তোমার কোল নিজের সন্ধানে / সত্যি নয় মিথ্যে; তুমি আছ তো মাঝখানে”।   


-------------------------------------------------------------------------------------------------

মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩