প্রায়শ্চিত্তের সবুজ অক্ষর
মৌচাকে ঢিল মারলে কি হয়? মৌমাছিরা ছত্রাখান হয়ে উড়তে থাকে। মানুষ আক্রান্ত হয়, বিভ্রান্ত হয়। মৌমাছির শান্তি বিঘ্নিত না করলে এ রকম হয় না।
প্রকৃতিও তাই। তাকে আঘাত করলে সে-ও প্রতিশোধ নেয়। শৈশবে
আমরা স্কুল থেকে ফিরতাম --– গাছের ছায়ায় ছায়ায়। আমবন জামবন পেরিয়ে। ঋতুতে ঋতুতে
গাছে ফলের সম্ভার দেখা দিত। আমাদের কর্মক্লান্ত ঘরে ফেরার খিদে মেটাতে মায়ের হাতের অমৃত হয়ে আসত সেই সব ফলগুচ্ছ। শুধু কী আমরা! আমাদের সমভোজী হতে জড় হত কত না নানা রঙের পাখি, বানর,
কাঠবিড়ালির দল। ওভাবেই আমি একদিন আবিষ্কার করি টাকসোনা পাখি। সে আমায় তার নীল
রঙের জাদুতে মুগ্ধ করেছিল। পরপর চারটি তেঁতুলগাছ ছিল, তার নীচে আমাদের জটলা বসত। এত সুউচ্চ সে গাছগুলো যে আমরা ঘাড় ওপরে তুলেও তার মাথা দেখতে পেতাম না। টুপটাপ
ঝরে পড়ত পাকা তেঁতুল। “কাঁচা তেঁতুল, পাকা তেঁতুল”-এর সুর মনে পড়ত। লেখক
তারাশঙ্কর ছিলেন আমাদের জেলার মানুষ। তাঁর ‘কবি’ উপন্যাসে ওই কথা পেয়েছি। আমাদের
ওদিকে তখনো কু ঝিক ঝিক ট্রেন। এক একটা ট্রেন চলে যেত আর মন খারাপে মুড়ে যেত শরীর। ধোঁয়া মিলিয়ে যেতে অনেক সময় লাগত। ট্রেন চলে যাবার পর স্টেশনখানা পড়ে থাকত
সন্তানহারা মায়ের মতো। ছায়াদায়ী গাছের নীচে আমরা দাঁড় করিয়ে রাখতাম আমাদের লাল
সাইকেল। থানার এক কনেষ্টবল আমাদের বন্ধু ছিলেন।
তাঁর সাইকেলে মোটরগাড়ির মতো হর্ন লাগানো ছিল। আমার স্বপ্ন ছিল কোনোদিন
আমারও ওরকম একটা হর্ন হবে। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখি আমার বাবা দাঁড়িয়ে
থেকে একটা মস্ত উঁচু আমগাছ কাটাচ্ছেন । কিছুটা দূরে নিমাইকাকা –-তিনিও। হাঁই হাঁই করে ছুটে গেলাম—করছটা কি তোমরা ? এ
সব গাছ যে আমাদের বন্ধু। আমাদের সঙ্গে সুখদুঃখের কথা বলে। বাবা এক ধমক দিয়ে বললেন---যা বোঝো না তা নিয়ে কথা বোলো না। গাছ না কাটলে জানলা দরজা হবে কিসে? আস্তে আস্তে বুঝতে শিখলাম --–সভ্যতা বড়
বালাই। এই সেদিন যখন যশোর রোডে শতাব্দীপ্রাচীন গাছেরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল তখন আমার
শৈশবে আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়া আমগাছগুলোর শোকে
কান্না ঝামরে এল চোখে। হায় নির্বাক গাছেরা --তারা জানেও না, যে কুঠার তাদের পৃথিবী ছাড়া করল সেই
কুঠারের বাটটা জুগিয়েছিল সেই গাছই।
কালে বর্ষতু পর্জন্যাঃ পৃথিবী শস্যশালিনী ---আমাদের
বালকবেলায় ঋতুচক্র ঘেঁটে যায় নি ওই আক্রান্ত মৌচাকের মতো। তখন আষাঢ়ে ঢল নামত, শ্রাবণে ধারা। বৃক্ষ
না কী বর্ষা আনে। বৃক্ষ দূষণ ধারণ করে মানুষের ফুসফুস বাঁচায়।
আমি স্বপ্ন দেখি বিজ্ঞানের সকল আবিষ্কারকে মজ্জাগত করেও এক
সমুন্নত আরণ্যক জীবন যে জীবন ঘিরে থাকবে শীতল ছায়ায় আর মোহিনী হাওয়ায় যে হাওয়া ভেসে আসবে
নিরুপদ্রব মানবজীবনরক্ষী একদল শাল অর্জুন পিয়াল
তমাল তেঁতুল বহেরা কুসুম হরীতকী সেগুন ও আমগাছের কাছ থেকে।
*****************************
সুবীর ঘোষ
দুর্গাপুর, বর্ধমান
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন