Featured Post

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

ছবি
   মুদ্রিত  নবপ্রভাত  বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য  লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি মুদ্রিত  নবপ্রভাত  বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য  প্রবন্ধ-নিবন্ধ, মুক্তগদ্য, রম্যরচনা, ছোটগল্প, অণুগল্প, কবিতা ও ছড়া পাঠান।  যে-কোন বিষয়েই লেখা যাবে।  শব্দ বা লাইন সংখ্যার কোন বাঁধন  নেই। তবে ছোট লেখা পাঠানো ভালো (যেমন, কবিতা ১২-১৪ লাইনের মধ্যে, অণুগল্প কমবেশি ৩০০/৩৫০শব্দে)। তাতে অনেককেই সুযোগ দেওয়া যায়। সম্পূর্ণ অপ্রকাশিত লেখা পাঠাতে হবে। মনোনয়নের সুবিধার্থে একাধিক লেখা পাঠানো ভালো। তবে একই মেলেই দেবেন। একজন ব্যক্তি একান্ত প্রয়োজন ছাড়া একাধিক মেল করবেন না।  লেখা  মেলবডিতে টাইপ বা পেস্ট করে পাঠাবেন। word ফাইলে পাঠানো যেতে পারে। লেখার সঙ্গে দেবেন  নিজের নাম, ঠিকানা এবং ফোন ও whatsapp নম্বর। (ছবি দেওয়ার দরকার নেই।) ১) মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখবেন 'মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা সংখ্যা ২০২৫-এর জন্য'।  ২) বানানের দিকে বিশেষ নজর দেবেন। ৩) যতিচিহ্নের আগে স্পেস না দিয়ে পরে দেবেন। ৪) বিশেষ কোন চিহ্ন (যেমন @ # *) ব্যবহার করবেন না। ৫) লেখার নীচে একটি ঘোষণা দিন:  'লেখাটি স্বরচিত ও অপ্রকাশিত'। মেল আইডি :  printednabapravat@gm

শেলী ভট্টাচার্য (অন্তহীনা)র দুটি গল্প


জয়জ্যোতি



ইনভাইটেশন কার্ডটা রামুদার হাত থেকে নিয়ে তাতে বাবার নামটা দেখলো দিব্যা। শহরের বিখ্যাত বিজনেস আইকন মি: রণিত রয়ের একমাত্র মেয়ে হয়ে কিছুটা গর্ব অনুভব হচ্ছিলোও বটে। সত্যি বাবাকে সে ছোটো থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে দেখেছে এই ব্যবসার পেছনে। হাজার স্ট্রেস, হাজার মিটিং, হাজার রিস্ক ফ্যাক্টর ... কতোকিছুকে সামলাতে হয় একটা সাফল্যের জন্য। মা যতবারই বাবার শরীর নিয়ে বলতে যেতো, বাবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটাই উত্তর থাকতো 'আমাকে উইনার হতে হবে। আরো আরো অনেক বড় বিসনেস ম্যান হতে হবে। বিশ্রাম সে স্বপ্নে ব্যাখাত ঘটাবে।'
অন্যদিকে দিব্যার মাকে তার কলেজের প্রফেসারির কাজ সামলে সংসার, মেয়ের পড়া, আর সামাজিকতা বজায় রেখে যেতে হয়েছে এককভাবে। কতোবার দুজনের মধ্যে লড়াই হয়েছে সংসার বনাম বিসনেস প্রায়োরিটির মাঠে। আসলে দিব্যার মা আর বাবা কিছু বিষয়ে সম্পূর্ণ উত্তর আর দক্ষিণ মেরুর। যেমন, দিব্যার মায়ের পার্থিব চাহিদার গণ্ডি বেশ ছোটো। অন্যদিকে অপার্থিব চাহিদাটি আবার বৃহৎ। আর ঠিক উল্টোটাই হল দিব্যার বাবার ক্ষেত্রে। ওনার ধ্যানজ্ঞান, স্বপ্ন, যুক্তি সবকিছু আদতে বিসনেসের চেয়েও বেশি অর্থের নেশায়। দিব্যা ছোটোবেলা থেকে কতো যে অশান্তি দেখেছে দুই ভিন্নপথের এই দুটি মানুষের মধ্যে। পার্থিব আর অপার্থিব সম্পদের টানাপোড়নে কতোদিন তো বিবাহ বিচ্ছেদের প্রস্তাবও উঠে এসেছিল এদের মধ্যে। যাইহোক, এতোকিছুর পর দিব্যার বাবার স্বপ্ন আজ পূরণ হতে তো চলেছে। সরকারের পক্ষ থেকে সম্মান প্রদান করার জন্য যে বাৎসরিক অনুষ্ঠান হবে বছর, সেখানে মি: রণিত রয়ের ইনভাইটেশন এসেছে। কতো সাকসেসফুল মানুষের ভিড়ে আজ দিব্যার বাবার নাম উঠে এসেছে এই ঝলমলে কার্ডে।
ভাবতে ভাবতে কার্ডটা উল্টেপাল্টে দেখতেই একটা নামে চোখ আটকে গেল দিব্যার। সূর্য ঘোষ। কতকটা কারেন্টে ঝটকা খাওয়ার মতোই চমকে গা নাড়া দিয়ে সোজা হয়ে বসলো সে। মূহূর্তে স্মৃতির সরণি দিব্যাকে নিয়ে গেল বছর চারেক আগের এক বসন্তে। সেদিন দিব্যার মায়ের শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাকে কলেজ থেকে নিয়ে এসেছিল এই ছেলেটি। সাথে একটি মেয়েও ছিল, নাম ছিল উর্মি। সেদিনই প্রথম দেখেছিল দিব্যা সূর্যকে। ভীষণ সাদাসিধা চেহেরা পোষাকের নিপাট মধ্যবিত্ত ঘরের ছাপযুক্ত ছেলে ছিল সে। কি একটা কারণে বড় অদ্ভুত লাগতো দিব্যার তাকে শুরুর দিন থেকেই। সেদিন ওদের বাড়ি এসে দিব্যার মাকে পৌঁছে দিয়েই সে বেরিয়ে গিয়েছিল। দিব্যার বাড়ির ঝা চকচকে অন্দরমহল, বড়লোকের ঘরের একমাত্র কন্যার আকর্ষণীয় রূপ ... কোনোকিছুতে নজর দেবার যেন কোনো অবকাশই ছিল না তার। কেমন যেন অন্যমনস্ক। পরে মায়ের কাছে জেনেছিল সূর্য নাকি কলেজে বাংলা অনার্সের ছাত্র। আর দিব্যার মা সহ প্রায় সব প্রফেসরেরই প্রিয় ছাত্র সে। কারণটা তার মেধাবী মাথা বা ভালো পরীক্ষার স্কোর নয়। বরং ওর অন্য সবার চেয়ে আলাদা কিছু মানসিকতা।
তারপর একদিন সেই ছেলেটাকেই দিব্যা বাড়ি ফেরার পথে এক জুয়া খেলার আড্ডাতে দেখে অবাক হয়েছিল। বাড়িতে গিয়ে মাকে বলেও ছিল সে কথা। ওর মা হেসে বলেছিল 'সূর্য নাকি অদ্ভুত রকমের। সমাজের কুস্থান বা কুসঙ্গ থেকে দূরে থেকে নয়, তার অন্তরস্থ কর্দমাক্ত কীটপতঙ্গের সাথে সহাবস্থান করেই, তাদের সমস্যা বুঝতে চায়। মেটাতে চায়। এরকমভাবেই নাকি এক রেল বস্তির মধ্যে গড়ে ওঠা দেশী মাদকের ঠাঁই ভেঙে তাদের অন্যভাবে বাঁচতে শিখিয়েছিল সে।' দিব্যা এসব শুনে অবচেতন মনেই ছেলেটার প্রতি একটু একটু করে আকৃষ্ট হতে শুরু করেছিল তখন। তার জন্ম যে মা বাবার জিনগত এক অদ্ভুত মিশ্রণে হয়েছিল। তার মনে ছিল মায়ের মতো অপার্থিব সৌন্দর্যময় মানুষের প্রতি আকর্ষণবোধ, আর বাবার মতো ক্যালকুলেটিভ মাথা। তাই হয়তো সূর্যর চোখে একটা উজ্জ্বলতা দেখেছিল দিব্যা। আর সেই উজ্জ্বলতায় পেয়েছিল এক বিরল মানুষ হয়ে ওঠার ক্যালকুলেশন। তারপর দিন কে দিন সেই উজ্জ্বলতায় নিজের হৃদয়কে পোড়াতেও শুরু করে দিয়েছিল দিব্যা। মায়ের কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতে শুরু করে দিয়েছিল সূর্যর একটু দৃষ্টিছটা দেখা পাওয়ার জন্য। তারপর দিব্যার মায়ের মধ্যস্থতায় একসময় আলাপচারিতা শুরু হয়ে যায় দুজনের মধ্যে। দিব্যার মা মেয়ের মনের ভাষা পড়তে পেরে নিজেও মনে মনে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। তাই হয়তো মাঝেমধ্যে সূর্যকে ডেকেও পাঠাতেন ওদের বাড়িতে। সূর্যও হয়তো কোথাও তার প্রিয় ম্যাডামের স্নেহের ছত্রছায়ায় বড় হওয়া কন্যাটিকে আপন ভাবতে শুরু করেছিল মনে মনে
কিন্তু কেউ কাউকে প্রকাশ করার আগেই মি: রয়ের চোখে পড়ে যায় ব্যাপারখানা। ওনার ব্যবসায়িক চোখ পরখ করে বলে ওঠে 'আমি এতোদিন এমনি এমনি গাধার ঘাঁটুনি খেটে এই জায়গায় আসিনি। কার মধ্যে কতটা পোটেনসিয়ালিটি আছে, আমি বুঝতে পারি।' তারপর সোজাসুজি সূর্যকে লক্ষ্য না করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বিজনেসের ভাষায় বলে ওঠেন 'কোনো লুজারকে আমি পছন্দ করিনা। আর আমি চাইনা আমার মেয়েও কোনোভাবে তা করুক।'
সেদিনের দাম্ভিক পিতার সামনে মাথা নিচু হয়ে গিয়েছিল দিব্যার। মা ঠিকই বলেন 'তোর বাবার যান্ত্রিক মাথা হয়তো চৌখস আছে, কিন্তু মানব মনটা এক্কেবারে ভোঁতা হয়ে গেছে। নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে।' খুব কষ্ট হয়েছিল দিব্যার সেদিন। কিন্তু সূর্য অদ্ভুত ছেলে। সেদিনও হাসিমুখেই কিচ্ছুটি না বুঝতে দিয়ে সবার সাথে কথা বলে বেরিয়ে গিয়েছিল। শুধু যাওয়ার আগে দিব্যার দিকে চেয়ে বলে গিয়েছিল 'আঙ্কেলের সাথে আমিও একমত। আই অলসো ডোন্ট লাইক টু লিভ এস লুসার। জীবন একটাই। কাজ যে অনেক।'
তারপর প্রায় চার চারটে বছর হয়ে গেছে, সূর্য একটিবারের জন্যও দিব্যার ধারেপাছে আসেনি। এমনকি আসার পরিস্থিতিকেও এড়িয়ে চলেছে। আজ এতোদিন পর কার্ডের ঝকঝকে ল্যামিনেটেড পাতায় ওই সাদামাটা ছেলেটার নামটা দেখায়, কেন যে সব স্মৃতি হুড়মুড়িয়ে সামনে চলে এলো দিব্যার মনের দর্পণে। সেটা হয়তো সে নিজেও জানে না। তারপর আবার নিজেই ভাবে, একই নাম পদবীতে কতো মানুষই তো আছে শহরে। হয়তো এই নাম অন্য কারো। হয়তো সে নিত্যদিনের উদয় অস্তের মধ্যস্থ কোনো সাধারণ সূর্য। সবার চেয়ে আলাদা বিরলদর্শন সূর্যজ্যোতি নয়।
তারপর দিন সাতেক পর এলো সেই দিন। দিব্যাও গেল তার বাবার সাথে। হয়তো বাবার সম্মানিত হওয়ার মূহূর্তের সাক্ষী হওয়ার সাথে সাথে আরেকটি গোপন কৌতুহলও ছিল মনের ভেতরে। মনের কোণঘেঁষা হয়ে ঘুরে ফিরে বেরাচ্ছিল একটি অবচেতন ইচ্ছা। সেই সূর্যোদয় আরেকবার দেখার।
অতঃপর এক এক করে নাম উচ্চারিত হতে থাকলো মঞ্চে। ক্যাটেগরি ওয়াইস বিসনেস আইকনে নমিনেশন পেলেন দিব্যার বাবা। কিন্তু শেষ অবধি মঞ্চস্থ হতে পারলো না তার উচ্ছ্বাস। অন্যকেউ নিয়ে গেল জয়ের সম্মান। দিব্যা বাবাকে বোঝাতে থাকলো 'এখানে নমিনেটেড হওয়াটাও একটা মারাত্মক সাফল্য' মেয়ে আর বাবার কথার মধ্যেই নাম উচ্চারিত হতে থাকলো সোসাল ওয়েলফেয়ার ক্যাটেগরির। সাথে চলতে থাকলো প্রজেক্টার প্রেসেনটেশন। এলো সূর্য ঘোষের নাম আর সাথে 'জয়জ্যোতি' গ্রুপের কাজ। আদিবাসী অঞ্চল, দুর্গম্য পাহাড়, সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রাম, যেখানে স্কুল নেই, বা থাকলেও শুধু কাঠামোতেই সীমাবদ্ধ শিক্ষার আলো। সেই সব জায়গায় পৌঁছে গেছে এই জয়জ্যোতি। সাক্ষরতার অভিযানে নেতৃত্ব দিয়ে মাত্র ২৫ বছর বয়সেই জয়জ্যোতির কর্ণধার এই যুবক, আজ হাজার হাজার মানুষকে সাক্ষর করে দিয়েছে। পেন্সিল পেন খাতার খরচ জুগিয়েছে নিজের সরকারি চাকরির সামান্য মায়না দিয়ে। আজ তার সাথে উৎসাহী সেচ্ছাসেবীর দলের সদস্য সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এক নতুন দিনের সূর্য। নতুন দিশার সূর্য। ...  মাইকের কথাগুলোর সাথে সাথে করিতালিতে মুখরিত হয়ে উঠলো সভাগৃহের আনাচকানাচ। এখনো মানুষ নিজে না পারলেও, কেউ এভাবে নিঃস্বার্থ সেবায় নামলে তাকে মুগ্ধ হয়ে শ্রদ্ধা করতে ভুলে যায় নি। আর সবকিছুর মধ্যে থেকেও এক অন্য ভালোলাগার জগতে বুঁদ হয়ে গেল দিব্যা। তার দুচোখ খুঁজে যাচ্ছে তখন শুধু সেই নামের মানুষটাকে। মঞ্চে সূর্যর ডাক এলো প্রথম স্থানে সম্মানিত হয়ে। দিব্যার অপেক্ষা যেন বাঁধ ভাঙার অপেক্ষায় তখন। কিন্তু হঠাৎ থমকে গেল তার হৃদস্পন্দন। ইনি কে উঠে আসছেন মঞ্চে? এতো সূর্য নয়। মূহূর্তে দিব্যার অন্তরস্থ সব আশাগুলো যেন নিষ্প্রাণ হয়ে গেল। দুচোখের জলে ঝাপসা হয়ে এলো সম্মুখের সবকিছু। তখনই কানে এলো কিছু কথা ...
'
দাদা আজ আসতে পারেননি। আমাকে পাঠিয়েছেন। আমাদের সানসাইন পরিবারের এক ভাইয়ের ক্যান্সার ধরা পড়েছে হঠাৎ। তাই তাকে নিয়ে চেন্নাই গেছেন দাদা। কিন্তু অডিও ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিয়েছেন সবার জন্য। একটু প্লে করুন না প্লিস।'
অত:পর দিব্যার তৃষার্ত কানে ভেসে এলো সেই পরিচিত শব্দতরঙ্গ। সেই চেনা মানুষটির অচেনা জয়ী আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠস্বর। আর কটা লাইন
'
আমি উইনার হতে চেয়েছিলাম। মানুষের বিশ্বাস জয় করে। কতোটা পেরেছি জানিনা! তবে এটা জানি, আরোও অনেক কাজ বাকি। অনেক জয়ের লক্ষ্য ছুঁতে বাকি। সে জয় মানবতার জয়। কলেজের এক ম্যাডামের একটি কথা খুব দাগ কেটেছিল মনে। আজ বলতে ইচ্ছা করছে, জন এডামসের উক্তি ...
"There are two educations. One should teach us how to make a living. And the other how to live."
হ্যাঁ আমি বাঁচতে শিখেছি, হাজার অসহায় শ্বাসের মধ্যে একটি মানসিকভাবে সহায়ক শ্বাস হয়ে।'
দিব্যার দুচোখ আনন্দে ঝলমলিয়ে উঠলো তখন। উঠে দৌড়তে লাগলো মঞ্চ থেকে মেডেল হাতে নেমে আসা ছেলেটির দিকে। পাশে একবার  বাবার নীরব চাউনির দিকে চেয়ে শুধু বলে গেল 'জয়জ্যোতি' ঠিকানাটা জেনে আসি।' মি: রয়ের দুচোখের ঘোলাটে ভাবটা কতকটা পরিষ্কার লাগছিল যেন তখন
 **********************


উপহার



"আরেকটু সময় দিন ওকে। অনেকগুলো আঘাত পেয়েছে যে পরপর। আসলে অপরিণত মনের পরিণত ভালোবাসাটা, এতো বছর পর এসে পরিণত বয়সে হঠাৎ কোনো কারন ছাড়াই ভেঙে গেল। আর তাতেই মূলত এক অবিশ্বাস গড়ে উঠেছে ওর মনে। তার উপর আপনাদের পরিবারের এইসব সম্পত্তিগত জটিলতা। কোট কাছারিঘরে সম্পর্কগুলোর ছিন্নভিন্ন অবস্থা। আপনার বাবার মৃত্যু, যিনি খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন ওর কাছে। সবমিলিয়ে ওর মনের ভাঙাগড়াগুলো এখনো সামলে উঠতে পারেনি ও। আরেকটু সময় দরকার।"
"আমি বুঝতে পারছি ডাক্তারবাবু। যে আমার মতোই ভালোবাসা কেন্দ্রিক জগতে থাকে। সেখানে তছনছ হলেই, বেসামাল হয়ে পড়ে। কিন্তু এভাবে আর কতো মাস চলবে? ঘুমের ওষুধেও যে ঘুম আসে না ওর। আর ঘুমালেই কিসব স্বপ্ন দেখে হাঁপিয়ে উঠে বসে পরে। কিন্তু জিজ্ঞেস করলেও, কিচ্ছুটি বলে না আমায়। নিজের মধ্যে গুমরায়।"
"দেখুন, আমিতো সবই বুঝেছি। আর ওকেও বারংবার বলেছি 'জীবনের খারাপ সময়কে অভিজ্ঞতাভিত্তিক সময় মনে করে এগিয়ে চলতে।' কিন্তু ঠিক এখনো মানিয়ে উঠতে পারছে না। তাই আমিও জোর করছি না। এটা যে শরীর নয়, এলোপ্যাথি হোমিওপ্যাথি আয়ুর্বেদী দেশি বিদেশি চিকিৎসা করে দ্রুত সারাবো। মনের চিকিৎসায় ধৈর্য লাগে।"
"আর কেউ যে এসব বুঝছে না ডাক্তারবাবু। সবাই ভাবছে মায়ের মতোই মেয়েও একটা পাগল, ইমোশনাল ফুল। আমি সহ্য করতে পারছি না এসব। এদিকে মাস্টার্স পরীক্ষার ফাইনাল সামনে। জীবনে কখনো একটিবারো খারাপ পরীক্ষা দেয় নি। কিন্তু এভাবে তো বই খুলতেই পারছে না এখন। ওর বাবা  ঘরে খুব রাগারাগি করছে। আমি যেন ঠিক সামলাতে পারছি না সব ..." বলতে বলতে ডাক্তারের সামনেই কান্নায় ভেঙে পড়লো বছর পঞ্চাশের কথা দত্ত
বাইরের সোফায় বসে তখন আনমনে বছর পঁচিশের কলি। আধোআধো তার কানে ভেসে আসছে ভেতরের কথোপকথনটি। তার প্রিয় মানুষটির চোখের জল মোছানোর জন্য মনের মেরুদণ্ডটাকে সে কিছুতেই শক্ত করে উঠতে পারছে না। বারবার চেষ্টা করছে। কিন্তু, প্রতিটিবার মাটির কাঁদার তালের মতো আকার নিচ্ছে তা। এক একটি ব্যাথা এক একটি আকারে তাকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। দুচোখ দিয়ে আগে অশ্রু ঝড়তো। এখন তাও মরীচিকার খোঁজে নিরুদ্দেশ
অত:পর ডাক্তারের চেম্বার থেকে মায়ের সাথে ঘরে ফিরলো কলি। হাতমুখ ধুয়ে বসলো জানলার সামনে। আজ কতো মাস ধরে তো এটাই তার দিন রাতের হতাশার ঠেক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যন্ত্রণাগুলো নেশাখোর হয়ে ওকে এখানে টেনে আনে। আর নিষ্পলক বসে চেয়ে থাকে বাইরের বাগানের দিকে। বাগানে ফুল ফোটে রঙবেরঙয়ের, ফল ধরে বিবিধ গাছে, সকালে সন্ধ্যেয় পাখিরা কলকলধ্বনি তোলে ... কিন্তু কলির সবই এক লাগে ... বর্ণহীন, নিস্তরঙ্গ। ঠিক কোন দিন কটার সময় থেকে এরকম জড়বৎ হয়ে গিয়েছিল, মনে নেই। তবে মনে আছে, শরীর মনের জড়াবস্থা মাত্রা ছাড়াতে প্রায় সাত মাস আগে ডাক্তার নিলাদ্রীর চেম্বারে প্রথম গিয়েছিল সে। তারপর থেকে চলছে ডাক্তার, প্রেসক্রিপশন, ওষুধ, মায়ের স্নেহের হাতের স্পর্শ, আর চারপাশের অসংখ্য বিরক্তির ভিড়। একটা সেকেন্ড যে মেয়ে কোনো কাজ ছাড়া বসে থাকতে পারতো না, সে এতোদিন ধরে সম্পূর্ণ কর্ম ইচ্ছাহীন। ক্ষুধা, নিদ্রা বা বাকি জৈবিক অনুভূতিগুলিও ঘুমন্ত। শুধুই অবিশ্বাসের একটা মস্ত বড় বিশ্বাস মনের মধ্যে জাঁকিয়ে বসেছে ... 'ভেঙে যাবে, সব ভেঙে যাবে'
সেদিন রাতেও এতোদিনের রাতের মতো কলির মা পাশে বসে ওকে বোঝাতে লাগলো 'জীবনে এমন অনেক ঝড় আসবে, তাতে সোজা হয়ে দাঁড়াতে জানতে হবে' ... মায়ের আরো অনেক কথার মধ্যে একটা কথা ওর জড়বৎ চিন্তায় কিছুটা ধাক্কা দিল 'তুই যদি সত্যি ভালোবাসতে জানিস, একদিন দেখবি অনেক নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ঘিরে ধরবে তোকে। তোর মনকে ভরিয়ে দেবে। জীবন পথের কয়েকটা পাথর কখনোই পুরো পথকে অমসৃণ করতে পারে না। সামনের পথে যে এগোতে হবেই তোকে।'
যদিওবা কলি অন্যদিনের মতোই নিশ্চুপ ছিল সেসব শুনেও। আর প্রতিটিদিন তার মায়ের একনাগাড় অশ্রুকণা সমর্পিত হচ্ছিলো ঈশ্বরের চরণে। তখনই হঠাৎ কলির ইউনিভারসিটি সূত্রে পরিচিত এক বন্ধু হতে একটা কাজের খবর আসে। কাজটি ছিল সপ্তাহে তিনদিন করে একটি কম্পিউটার সেন্টারে দৈনিক চার ঘন্টা করে পড়ানো। কলির মায়ের অনেক বোঝানোর পর সেই ইন্টার্ভিউতে যায় সে। অবশেষে চাকরিটাতে তাকে পরের দিন থেকেই জয়েন করতে হয়। এইসব ঘটনাগুলো অলক্ষ্যে এক অদৃশ্যকরণশক্তি দ্বারা বোধ হয় নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিলো। নইলে স্থবির কলির এমনভাবে সচল হওয়াটা অসম্ভব হয়ে পরেছিল তখন।
তারপর সেই সেন্টারে পড়াতে গিয়ে কলি এক এক দিন করে মিশে যেতে থাকে তার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। ডুবে যেতে থাকে পড়ানোর নেশায়। অর্থনৈতিকভাবে খুব একটা সচ্ছল ছিল না সেই পরিবাগুলো, যাদের ঘরের বিবিধ বয়সী ছেলে মেয়ে সেখানে পড়তে আসতো কলির কাছে। তাদেরকে সে কম্পিউটার স্কিলে দক্ষ করে সংসারের হাল ধরার শক্ত কাঁধ করে গড়ে তুলতে বদ্ধ পরিকর হয়ে পড়ে। আর সে কাজের মধ্যে ডুবে কখন যে সে নিজেই শক্ত হয়ে দাঁড়ায়, তা টেরও পায় না। যেমন একদিন দিন ক্ষণ না জানিয়েই হতাশা কাটানোর ওষুধগুলো জমায়েত হয়েছিল ওর দৈনন্দিন রুটিনে, ঠিক তেমনি জীবনের রুটিন থেকে সেগুলো অজান্তেই বাদ পড়ে যায়। কলির পরিচিতি হতে থাকে 'ম্যাডাম' শব্দ ঘিরে এক অদ্ভুদ আপন করা ডাকে। চাহিদা বাড়তে থাকে তার পড়ানোর কৌশলের, আর সাথে সপ্তাহে তিনদিনের জায়গায় ছয়দিনের ডিউটি পড়ে। পড়ানোর আগে পরের সময়ে তার ছাত্র ছাত্রীরা ভিড় করতে থাকে সেই সেন্টারে। তাদের প্রিয় ম্যাডামের সাথে ভাগ করে নিতে থাকে তাদের ব্যক্তিগত হাজার সমস্যাকে। আর কলিও তাদের এক একটি সমস্যাকে সমাধান করতে উঠে পড়ে লেগে যায় সাধ্যানুযায়ী। আর এসবের মধ্যেই গড়ে উঠতে থাকে এক অদৃশ্য আত্মীয়তা বলয়।
তারপর একদিন এক ছাত্রী তাকে জিজ্ঞেস করে "ম্যাডাম, আপনি শাড়ি পরেন না?"
"
কেন বলোতো?" অবাক উত্তর কলির।
"
না মানে সালোয়ারেই দেখি তো সব সময়। কাল তো শিক্ষক দিবস, একটু শাড়ি পরে আসবেন? আমরা সবাই মিলে ছবি তুলবো আপনার সাথে।"
"
ঠিক আছে, আসবো। আসলে ট্রেনে করে এসে আবার অটোতে করে আসতে হয় তো। তাই .. আর কি। আর তেমন অভ্যাসও নেই যে। কিন্তু, কাল আসবো। তোমরা যখন বললে, নিশ্চয়ই আসবো।" মৃদু হেসে উত্তর দেয় কলি
পরেরদিন কলির বিকালে পড়ানোর কথা। একটু আগেই দুপুর একটা নাগাদ সে পৌঁছে যাবে বলে বাড়ি থেকে বেরোয়। পথের মাঝেই সেন্টারের কেয়ারটেকার শঙ্কর দায়ের ফোন আসে।
"
কলিদি, আপনি কি সকালের ব্যাচের ছেলে মেয়েদেরও আজ ডেকেছিলেন?"
"
নাতো। কেন বলুন তো?"
"
না মানে, সেন্টারের বাইরে চা খেতে গিয়ে দেখি, সকালের ব্যাচের অনেক স্টুডেন্টস এসেছে। আর এখন তো উপরে এসে ক্লাসরুমেও বসেছে সব আমায় এসে সৌরভ জিজ্ঞেস করে গেল যে 'ম্যাডাম কখন আসছেন?'"
"
তাই? আমিতো কিছুই জানি না। দাঁড়ান আসছি আমি।"
 মিনিট পনেরোর মধ্যেই কলি ঢুকলো সেন্টারে। ওকে দেখেই শঙ্কর ইশারা দিয়ে রিসেপশন রুমে ডাকলেন। আর নিচু গলায় বলতে লাগলেন
"
আরে আপনারা এসব প্ল্যান করেছেন, একবার বলবেন তো আমায়। আমি তো কিছুই জানি না। এই সেন্টারে তিন বছরে কখনো এসব হয়ও নি। এখন এই বাচ্চাগুলোকে না খাওয়ালে খারাপ দেখায় না?"
আকাশ থেকে পড়ার মতো মুখ করে কলি ইতস্ততভাবে বলতে থাকে "আপনি কি বলছেন? কিসের প্ল্যান? আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না।"
"
আরে ওরাতো ক্লাসরুম সাজিয়েছে। আপনার জন্য গিফট এনেছে।"
কলির নীরব মনে তখন হাজার প্রশ্ন ... এই ক্লাস নাইন টেনের সাইকেলে দুজন করে চেপে আসা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া ছেলেমেয়েগুলো টাকা পেল কোথায়? কলেজে পড়তে পড়তে, নিজে টিউশন করে পড়ার খরচ চালানো ছাত্র ছাত্রীগুলো কিকরে এসব করলো? কেন করলো? ওর জন্য? কে ? এক সামান্য কম্পিউটার টিচার, যে সপ্তাহে এক একটা ছাত্র ছাত্রীকে গড়ে ছয় ঘন্টা মতো টিউশন দেয় তিনদিনের হিসাবে। তখনই কলির ভাবনায় ছেদ পড়লো এক ছাত্রীর ডাকে।
"
ম্যাডাম এসেছেন? কি ভালো লাগছে আপনাকে শাড়ি পরে। আসুন ক্লাসরুমে। শঙ্করদা, আপনিও আসুন।"
কেমন একটা মন্ত্রমুগ্ধের মতো কলির পা এগিয়ে গেল ক্লাসরুমের দিকে। চারদিকে চেয়ে দেখলো, সারাটা ক্লাস রঙিন কাগজে সাজানো, বোর্ডে বড় বড় করে লেখা 'আমাদের প্রিয় ম্যাডাম ... কলিদিকে শিক্ষক দিবসের অনেক অনেক শুভেচ্ছা ভালোবাসা'
কলি আবার স্তব্ধ হয়ে গেল জীবনপ্রবাহে। তবে এবার যন্ত্রণায় নয়, আনন্দে, নিঃস্বার্থ ভালোবাসার অনাবিল আবেগে। তারপর এক একটা ব্যাচের ছেলেমেয়েরা এগিয়ে এসে ওর হাতে তুলে দিতে লাগলো রঙিন কাগজের এক একটা মোড়ক। তাতে কি ছিল, সেটা জানাটা গল্পে হয়তো অতোটা গুরুত্ববহ নয়, কারণ সবকিছুর উপরে তখন গুরুত্ব পাচ্ছিলো শিক্ষাস্থলে গড়ে ওঠা নিঃস্বার্থ ভালোবাসার এক উজ্জ্বলতা।
যে চোখের জলগুলো মরীচিকার খোঁজে হারিয়ে গিয়েছিল একদিন, সেগুলো আবার কলির জীবনে ফিরে এলো আনন্দাশ্রু হয়ে। চোখের জল মুছতে মুছতে সে উপহারগুলো বুকে জড়িয়ে ধরে আবেগে গুণগুণিয়ে উঠলো
'না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, তেয়াগিলে আসে হাতে,
দিবসে সে ধন হারায়েছি আমি---পেয়েছি আঁধার রাতে।।'
আর মনে পড়ছিল মায়ের সেই কথাখানা 'তুই যদি সত্যি ভালোবাসতে জানিস, তবে দেখবি অনেক নিঃস্বার্থ ভালোবাসা তোকে ঘিরে ধরবে একদিন।'
==========000==========

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৯তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮০তম সংখ্যা ।। কার্তিক ১৪৩১ অক্টোবর ২০২৪

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত

মুদ্রিত নবপ্রভাত উৎসব ২০২৩ সংখ্যার ডাউনলোড লিঙ্ক