Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

পিনাকী চক্রবর্তী

মহাকালেশ্বর রহস্য  
(একটি  স্মার্ট সিটি  বা  আদর্শ নগরীর  রূপকথা )

                      

-দিনকাল আর আগের মতন নেই রে...  নগরের গোষ্ঠী   সংঘর্ষ   থামবার  নাম নেই ! 
-এমনটা  আগে  ছিল না  । আমরা  শান্তিতেই  থাকতাম  !
- আগে আমরা সবাই  একসাথে থাকতাম      এখন  কিছুতেই  মন  ভরছে  না  । মনে হচ্ছে  আরও  চাই ।   এই  বাড়তি  চাহিদার  জন্য  পরিশ্রম করতেও  মন   সায়  দেয় না    
-এটা  ইদানীং আমার  মধ্যেও  হচ্ছে ।  কিছু  বুঝতে  পারছিস ? আমিতো  কিছুই  পারছিনা  বুঝতে।
-আমিও ছাই  কিছুই  বুঝিনি । আসলে    আশ্রমে  গিয়েছিলাম   ফল আর যজ্ঞের কাঠ  দিতে  । দেখলাম  সেখানকার  ঋষিরা  খুবই  চিন্তায় । তাদের  মুখ  শুকিয়ে  গিয়েছে ।  মনে হল  কোন  বিপদ  আসছে !
-বিপদ !খুলে বল  , তুশ ...
-হ্যাঁ ।  আমি  বটগাছের  তলায়  কাপড় পেতে  শুয়ে  আছি , দুপুরবেলা  । কিছুটা  দূরে এক বৃদ্ধ  ব্রাক্ষ্মণ  আর তাঁর  চার ছেলে  বসে  গল্প করছিলেন ।  তাঁদের কথা কান পেতে শুনলাম । কথা খুব আস্তে  হচ্ছিল না , তবে হ্যাঁ  মুখের   শব্দ  থেমে –থেমে আসছিল   তাঁরা বুঝতেও পারেননি , কেউ সেই কথা  শুনছে !
-কী  শুনলি ? তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে  খুব চিন্তায় আছিস ।
 বিকেল ভেঙে  সন্ধ্যা হচ্ছে   জলাশয়ের ধারে   ওরা  দু’জনে  বসেছে । তখনই  সূর্য ডুবে  গেল । 

জঙ্গলের মাথায়   কেউ যেন   চাদর  চাপা দিয়ে গেল !  এই জঙ্গলে  অনেকের  মতন  ওরা  দু’জনেও  কাঠ , ফল – সংগ্রহ করতে  আসে ।  এইসব  কিছু   আশ্রমে পৌঁছিয়ে  দেয় নিজেদের হাতেই    এটা  তাদের  জীবিকা । এই কাজের  বিনিময়ে  তারা  খাবার পায় ।  কাপড় পায় , ব্যবহার করবার জন্য  
জঙ্গলে  বসে , তাদের  ভিতর  কথা   হচ্ছিল । রোগা  দু’জনেই  । যে  খুব চিন্তায় রয়েছে , অপেক্ষাকৃত  দুর্বল  স্বাস্থ্যের অধিকারী ;  তুশ বলল 
-আমি কান পেতে শুনলাম ।  আমাদের  অবন্তীর   অবস্থা  বেশ  চিন্তার ।
উল্টো  দিকে  বসে  থাকা  , লম্বা রোগা  আর  ভারী  গলায় লোকটি  বৃকোদর । বলে উঠল – আরে  , অত  পুঁথিবাক্য  না ঝেড়ে  পরিষ্কার ভাবে  বল –

দু’জনেই মধ্যবয়স্ক ।  সমবয়সী । তুশ বলল  -  ওঁরা  একটা  গল্প   বলল ।
-গল্প !
-মন  দিয়ে   শুনলেই  সব  পরিষ্কার হয়ে যাবে ।
-থামবি না    বল ...  
চারজন পুত্রের  মধ্যে  প্রথমে  বড়  ছেলে  বলল -  পিতা , আপনি  বলছিলেন , আমাদের এই  নগরটি আগের  মতন  সুরক্ষিত  নয় । এখানে  অনেক  পরিবর্তন  আসতে  চলেছে ।  এইসব  পরিবর্তন  গুলো  সম্বন্ধে  আমাদের  জানাবেন । 
আরেকজন  , সে   মেজো ছেলে , বলল -  আমরা  এত দিন  বেশ  শান্তিতেই  ছিলাম এখন আবার  নতুন  করে  কিছু  উপদ্রব  দেখা  দিচ্ছে ।  আমরা যে  পরিকল্পনা  করেছিলাম  তাতে  বেশ  সমস্যা ।
এত  কিছু শুনে  ছোট  ছেলে  বলল – পিতা  আপনি জানেন ,  বেশ কিছু  নিম্ম বর্গীয়  মানুষেরা  বিক্ষোভ  দেখাচ্ছিল । তাদের  বিরোধ  ছিল আমাদের  উপর । তাদের  কথায় , আমরা  তাদের  উন্নতির  পথে অন্তরায় । আমরাই  তাদের  হত দারিদ্রতার  জন্য  দায়ী এমনটা   হলে  আমরা  উন্নয়নের  কাজ  করতে পারব না ?
পিতা  বললেন – তারমানে  এই সমস্যার  আভাস  পেয়ে  গিয়েছো । আজ  এখানে  আমরা  মিলিত  হয়েছি , এই  বিষয়টির জন্যই ।  আমি  তোমাদের  একটা  ঘটনার  কথা  বলব । মন  দিয়ে  শুনবে ... 


                   ২ 
সদ্য সূর্য  উঠেছে । খুব  ভোরেই  নগরের মুখে  যাত্রা  শুরু  করলাম ।  শুনেছি শিপ্রা নদীতে  জল   নিয়ে  গণ্ডগোল  শুরু  হয়েছে  এখনাকার সমস্যা  হচ্ছে  , আমরা  সবাই  জল পান করি , জমিতে চাষের  জন্য  জলের   ব্যবহার  করি , ফসলের  সবুজ  রঙে  যখন নদীর   পাশের  অঞ্চল ভরে  যায় – উৎসব করি ।  এই  নদীর  প্রতি যে  আমাদের  মানুষের  দায়িত্ব  রয়েছে , ভুলেই  গিয়েছি !  ভগবানের  প্রতি দায়িত্ব  পালন  করছি । শুধু   প্রকৃতির ক্ষেত্রেই    উদাসীন !
আমার অনুচরেরা  এসে খবর  দিয়েছিল ,  শিপ্রা  নদীর  চড়  ক্রমশই  দূষণে  ভরে  উঠেছে ।   কয়েকদিন  ধরেই , নতুন  ফসল  উৎপাদনের  জন্য  পুজো  করা  হয়েছিল ।   সেই সামগ্রী ,  ব্যবহৃত  জিনিস – সমস্ত  কিছু  নদীতে  বিসর্জন  করা  হয়েছে । সেখান থেকেই এই  সমস্যা ।
আমি  খুব তাড়াতাড়ি নদীর  দিকে  হেঁটে  চলেছি । কেননা এখানকার  অবস্থা  খুব একটা  ভালো  নয় । আমাদের  বিরোধী  শিবির  যে কোন  সুযোগে  ঝামেলা  করতে পারে  । শুধু ঝামেলা নয় , এই ঝগড়া  দেখতে  - দেখতে  গোষ্ঠী লড়াইয়ের  আকার    নেবে    আমি তাই খুব  দ্রুতই  পা চালিয়ে  যাচ্ছিলাম

নগর  পেরিয়েছি  মাঝে  খুব ছোট্ট জঙ্গলের  সরু  রাস্তা  ধরেছি , খুব তাড়াতাড়ি  যাব  বলেই  এই  পথে   এলাম । আচমকাই  তিনজন  আগন্তুক  আমার  সামনে এসে দাঁড়ালো । আমি  বিরক্তই  হলাম ।
তাদের চোখ  দেখে  মনে হচ্ছিল , খুব সাধারণ ।
-আপনি মহাকালেশ্বর   দর্শন  নিয়ে  চর্চা  করছেন ?
আমি বেশ  কিছুটা  অবাক   হয়ে  গিয়েছিলাম  !  এই   চর্চা  আমাদের  একান্ত ।   দীর্ঘ পাঁচ  বছর  ধরে  গবেষণা  করে  আসছি । এর  রহস্য  সবটাই  এখনো  আমাদের কাছে অজানা। তবে  এটাও  ঠিক  আমাদের  অনুসন্ধান  বেশ এগিয়েছে ।  আর এর  সুফল  আমরা  পেতে পারি অদূর  ভবিষ্যতে ।  আমাদের এই গোপন বিদ্যার  কথা  , আমাদের  খুব কাছের  লোকজন ছাড়া কেউ জানেনা ।  এনারা  কোন  তরফের ? আমাদের এই  দর্শন  এখনো  প্রয়োগ করিনি , অথচ এই  গুপ্ত বিদ্যা  নিয়ে  ইতিমধ্যে  যে  বিকল্প  শিবির  তৈরী  হচ্ছে  , টের  পেলাম 
-হ্যাঁ । আপনারা !
আমি জানতাম  লুকিয়ে  লাভ নেই ।  বরঞ্চ  এই লোক  গুলোকে  চিনবার  চেষ্টা  করি । আমার  কথা  শুনে   তাদের  মধ্যে  থাকা  একজন  যুবক  বলল – ব্রাক্ষ্মণ , আমাদের সাথে  আসুন ।
-কোথায় ?
-আপনি  আমাদের  বিশ্বাস  করতে  পারেন । আমরা দস্যু  নই । আপনার  ক্ষতি করব  না ।  শুধু  চোখ  দুটো  কালো  কাপড়ে  বেঁধে  দেব । জঙ্গলের  দূরেই  আমাদের  রথ । কষ্ট  হবে না । এইবার  অনুমতি দিন ।
কিছুটা  ঘাবড়ে  গিয়েছিলাম । তাদের গলায়   এমন   দৃঢ়চেতা   ভাব , মনে  হল  আমার  অনুমতির অপেক্ষা  শুধু মাত্র  নিয়ম মাফিক ।  আমি বললাম –এখন আমাকে শিপ্রা  নদীতে  যেতে  হবে সেখানে   সকাল  থেকেই ঝামেলা শুরু হয়েছে ।
-আপনি এত ভাববেন  না । সেই ঝামেলা এখন  আর নেই । আপনি আমাদের সাথে আসুন ।
-মানে ?
-ঝামেলা আমরাই  বাধাই । আবার আমরাই  মিটিয়ে  দিয়েছি । আপনাকে    অপহরণ করব  বলেই  এই সব  কিছু আয়োজন । আপনার  আশ্রম  থেকে  এখানে  আসতে   জঙ্গলের পথ  রয়েছে  , পাছে  আপনি এই  পথ দিয়ে  আসেন , আমরাও  অপেক্ষা  করছিলাম । শিপ্রা  নদীর তীরেও  আরেক দল রয়েছে ।
-আমি  কিছুই  বুঝতে পারছিনা ! তোমরা নিজেদের  পরিচয় দাও ।
-আমরা  অনুচর  দূষণের । এখন  আপনি  আমাদের  সাথেই  যাবেন ।
-দূষণ  কে ?
-মাপ  করবেন , এই  বিষয়ে  আর  প্রশ্ন  ক্রা যাবেনা ।
আমার  কিছু  বলবার আগেই , একজন  কালো  কাপড়  আমার  দুই  চোখের  পাতার উপর  রেখে  মাথার  পিছনে  বেঁধে  দিল । আরেকজন  হাত  দুটো   বেঁধে  দিয়েছে ।
আমি  বুঝলাম এখন  আমার  কাজ  ওদের  অনুসরণ  করা ।

চোখ  যখন খুলল , মনে  হয়েছে ,    দীর্ঘক্ষণ  সুড়ঙ্গের  ভিতর  যে  আলোর  খোঁজ  চলছিল , তারই  সন্ধান     অনেকক্ষণ  আলো  ছিল না ।  তাই প্রথমে  চোখ  ঝাপসা লাগছিল ।  দু’হাতে  চোখ  মুছে  দেখলাম ,  চারপাশটা  অন্ধকার । আমি  নিজে  সেই  অন্ধকারের  ভিতর  ছোট্ট   বিন্দু !   বুঝতে পারছিনা , রথের  উপর  জখন যখন দাঁড়িয়ে  ছিলাম  , টের পাচ্ছিলাম  পথ সমতল  নয় ।     রথ  থামল ।  বেশ  কিছুটা  হেঁটে   এলাম    চোখ  খুলতেই  অন্ধকার !

-আসুন  ব্রাক্ষ্মণ ...
 গলাটা  বেশ ভারী ।  কানে  ছুঁয়ে গেল ! ঘাড়  ঘুরিয়ে বক্তাকে  খুঁজবার  চেষ্টা  করছি । আবার  হাসি  শুনতে  পেলাম 
-আপনি আমাকে  দেখতে  পাবেন  না । আমি  অদৃশ্য , এমন ভাবেই   আমাদের  মধ্যে  কথাবার্তা হবে    অসুবিধা  নেই  তো ?
-না নেই ।
‘না  নেই’ --  , কথাটা  বলেও ,  নিজেকে  বিশ্বাস করতে পাচ্ছিনা !  এমন পরিবেশ  এর আগে   আমি উপলব্ধি  করিনি ।  প্রাণের ভয়  নেই ।  একটা  অস্বস্থি   ,নাভি  থেকে  গলা অব্দি   দম  বন্ধ ভাব  উঠে  আসছিল ।  নিঃশ্বাস  নিতে  কষ্ট  হচ্ছে । 
আমি বললাম – আপনি কে  ?  এমন  ভাবে আড়ালে  থেকে  কথা  বলবেন !
লোকটির  তীব্র  হাসির  স্বর  শুনতে  পেলাম    মনে  হচ্ছে ,  বুকে   ধাক্কা  মারল   
আমি  বললাম – আপনি সামনে  আসুন ।  আমি  নিরস্ত্র  আর  আপনাকে  আক্রমণ করবার সামর্থ্য  নেই ।
-থাকলেও  মারতে  পারতেন না । আমি   গুপ্ত বিদ্যার  চর্চা  করি । 
-তাই  নিজেকে  আত্মগোপনেই  রেখে  দেবেন  ?
-প্রয়োজনে ।
-আপনার  এমন  লুকিয়ে  থাকবার  দরকার কী ?
-আছে  । এর  উত্তর   পড়ে দেব    তবে  আপনার  নিজের  জন্যও  আমার  বীভৎস মুখ দেখার  দরকার  নেই    অহেতুক  আতঙ্কিত হবেন 
-একদম  নয় । ব্রাক্ষ্মণরা  সহনশীল  হয় । আপনি  দেখান  , আমার  ক্ষতি  হবে না ।
-আমি  দূষণ । একটা  বিশেষ  কারণে আপনাকে  এখানে   নিয়ে  এসেছি , এমন  ভাবে  নিয়ে  আসবার জন্য  , পারলে  ক্ষমা  করবেন । 
আমি  খানিক  অবাক  হয়ে  গেলাম    বললাম – আপনি  কোথায় ?
-এই  গুহার  ভিতর  এমন  জায়গা  রয়েছে , আমি  আপনাকে  দেখতে  পাচ্ছি । আপনি  আমার গলার  স্বর  শুনলেও । দেখতে পাবেন না
-এই লুকোচুরির  দরকার  আছে  ?
-এটা  ভবিষ্যৎ  বলবে । এখন  এই  নিয়ে সময়  নষ্ট  করে  লাভ  নেই । সময়  আপনার কাছেও  দামী । আমার কাছেও ।  আসুন আমরা  আলোচনা  করি ।
-কোন  বিষয়ে ?
-আপনি  অবন্তী  নগরকে  আদর্শ  নগর  হিসেবে  গড়ে  তুলতে  চাইছেন ।  এখনাকার অধিবাসীদের   বিদ্রোহী  করে  তুলছেন ।  আপনার নগরে  শুধু ব্রাক্ষ্মণ  নয় ক্ষত্রিয় , শূদ্ররাও   রয়েছে । এদের  ভিতর  থেকে  আপনি   ভয় ,  নিয়ম তুলে  দেবেন  ?
-আমি  বুঝতে  পাচ্ছিনা    আমার  নগরে  সব  শ্রেণীর  মানুষ  নিজের  মতন  থাকেন  । তাদের একত্রে  থাকবার  কোন সমস্যা  নেই     থাকলেও  খুব  সামান্য ।  আমি তাদের  সকলকে  নিয়ে শুধুমাত্র  গবেষণা করছি । বলতে  পারেন  অবন্তী   নগরকে   মানব সম্পদের  উন্নয়নের  জন্য  পরীক্ষাগার  হিসেবে  ব্যবহার  করা  হচ্ছে ।
-এখানেই  আমার আপত্তি । আমি চাইছি  আপনি এই কাজ থেকে  দূরে থাকুন । এইধরনের  পরীক্ষা  বেশ  বিপদজনক ।
-কেন  ?
-দীর্ঘদিন  যে  ব্যবস্থায়   মানুষ  বসবাস করে , সেই  ব্যবস্থাই তার  নিজের  । সেখানে  সে  সবচেয়ে  বেশী  মানিয়ে   নেয় ।  স্রোতের  বিপক্ষে  সাঁতার  দিতে  গেলেও ,  স্রোতের খানিক  সহযোগিতা  দরকার ।
-  দক্ষ সাতারুর  আত্মবিশ্বাস  থাকলে  বিপক্ষ  স্রোতকেও ,  নিজের   জন্য              ব্যবহার  করা  যায় ।
- ব্যবহার  ! আমি এই কথাই বলছিলাম । মানুষকে  ব্যবহার  করছেন  ভালো , তবে  নিজের  উন্নতির  জন্য  করাটাই  বুদ্ধিমানের  কাজ 
-আমি  নিজের স্বার্থেই তাঁদের  ব্যবহার করছি ।  দেখুন   আদর্শ  নগরীর  স্বপ্ন  সফল  হলে ,  আমাদের  পরের  প্রজন্ম  সুস্থ থাকবে  । এটা  আমাদের কাছে  বড়  পাওনা ।  ভবিষ্যৎ  প্রজন্ম রক্ষা  করতে পারাটাই  আমার স্বার্থ । 
-আপনি আমাদের হয়ে  কাজ  করুন ।  নদীর  জলে  সকলের  উপর  অধিকার  ঠিকাছে । তাইবলে  নিঃশুল্ক   করে  দেওয়া  ঠিক  নয় ।
-একটা  আদর্শ  নগরীতে  জল  আর খাদ্য  সকলের  কাছে  পৌঁছাতে  হয় । শিশু মৃত্যুর  হার যেন  কমে  । অপুষ্ট   শিশু  যেন  না  জন্মায় । আমি সেই চেষ্টাই  করছি । এই সব  কিছুর আগে  দরকার  শ্রেণীমুক্ত  সমাজ । এখন  সমাজে  যারা পিছনে  রয়েছেন তাদের  ভর্তুকি  দিয়ে  একটা  নির্দিষ্ট  সময়ের  মধ্যে   তাদের  মধ্যে  আর্থিক  বৈষম্য  মিটিয়ে দেব   এরজন্য  অবশ্য  নগরের  প্রাকৃতিক  উপাদান  গুলোর  দায়িত্ব  নগর  প্রধানের  হাতেই । সেই   উপাদান  সকলের  জন্য  ব্যবহার  করা  হবে    নির্দিষ্ট  সময়ের  জন্য  সকলকে  সুযোগ দেওয়া  হবে    এর  বদলে  অবশ্য  নগরের জন্যও নাগরিকদের  সেবা  দিতে  হবে  । এমন ভাবেই  দেওয়া  -নেওয়ার  মাধ্যমে  চলবে  সমাজ ।
-এই  ব্যবস্থায়  যদি  কেউ  ভালো কাজ  করে ।
-নিঃসন্দেহে  সে  এগিয়ে থাকবে । 
-তাতে  শ্রেণী বিভাজন  কমবে ?
-যদি  আপনি  নিজের  দু’ হাতকে ব্যবহার   করতে না  পারেন  ,  পিছিয়ে  পড়বেন ।  প্রতিযোগিতা হবে  নিজের  সামর্থ্যের  সাথে  অন্য  সামর্থ্যের    সমাজ  কোন  স্তর  আরোপিত  করবে না  । এটাই  আমার  শ্রেণীমুক্ত  সমাজের  পদ্ধতি 
-আমি প্রকৃত অর্থে এমন নগর তৈরী করতে চাই , যেখানে  নগরের  হাতে  কোন দায়িত্ব থাকবেনা    প্রাকৃতিক সম্পদ  ব্যবহারের ।  নাগরিকরা   অসীম  সুখ  ভোগ  করবে । তারা   স্বাধীন । যে  যেমন ভাবে   নিজেদের  দায়িত্ব  নেবে     নগর  কোন  কিছুতেই  মাথা    গলাবেনা ।
-এমন  ভাবে  ক্ষতি  শুরু  হবে  । এক  পক্ষের  হাতে   প্রচুর   সম্পদ  আর  অন্য পক্ষ  সমাজের  প্রান্তিক  সীমায়  থাকবে   
-তাইতো  বলছি  , সভ্যতা  কখনই  শোষণ মুক্ত  হবে  না । কেননা  মানুষের  ভিতরে  অন্যের উপর   কর্তৃত্ব করবার   যে  প্রবণতা , তা  শাশ্বত  শোষণ  থাকলেই  শ্রেণী সৃষ্টি  হবে । শ্রেণীহীন   সমাজের কল্পনা  অলীক ,  মিথ্যা   চিন্তা  
-আমি  শ্রেণী বিলুপ্ত  সমাজের  কথা  বলিনি । আমি   বলেছি  মানুষ যেন নিজের  সামর্থ্যেই  সমাজের  শ্রেণীগত  অবস্থানের  পরিবর্তনে  সক্ষম হয় ।
-দেখুন , নগরের  শাসক  নিজের স্বার্থেই  এমনটা  হতে  দেবেনা     কারণ  যে  সমাজে শ্রেণী  থাকেনা  , সেখানে   শাসকের  বিরুদ্ধে লড়াই  সরাসরি করা  যায় ।  এটাই মহাকালের  বিধান ।  
-খুবই  বিপদজনক ।   এই  বিধানে  আদর্শ  সমাজ  তৈরী  হতে পারেনা ।
-মানে  ? আদর্শ  সমাজ বলে  কিছুই  নেই  ! যা অনেক  সময়  পর্যন্ত টিকে  থাকে  , তাই  আদর্শ হয়ে  ওঠে ।  আমরা  দু’জনে  মিলে  একটা  নতুন  নগরের  নির্মাণ করব । 
-সেই  নগর  পরিচালনার  দর্শন  কী  হবে  ?
-আমি   যেই দর্শন  এতক্ষণ  আপনাকে  বললাম ।  অবাধ   ভোগ –বিলাসে  দিন  কাটানো । 
-আপনি   আদর্শ  সমাজ বলতে   এমনটাই   বোঝেন ?
-যেখানে ,  মানুষের চাহিদা শাসকের উপর নির্ভরশীল  না  থেকেও  নির্ভর  করবে । এমন  স্বাধীনতা দেওয়া  হবে  , যাতে নিজেদের   চিন্তার আর   মুক্তির  পরিসীমা যাবে   !  সে  ভুলে  যাবে  কতটুকু  তার  চাহিদা  । এই  কৃত্রিম  আকাঙ্খাই  , চাহিদা আর   লোভের  জন্ম দেয় ।   আমরা কেউই  ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা । নাগরিকদের চাহিদার দিকে তাকিয়ে কখনোই  শাসক চলতে পারবে না।  কেননা চাহিদাকে কখনই একটি নির্দিষ্ট  সীমায় আটকে রাখা সম্ভব  নয় । তাই তাদের নিজেদের ভিতরেই  নিজেদের আটকে রাখতে হবে । ভেদাভেদ সেই      অমোঘ অস্ত্র – যা ব্যবহার করলে  নাগরিকরা নিজেদের সাথে নিজেরাই  বিবাদে মত্ত থাকে । শাসকের সুবিধা হয় । আমি এই  দর্শনেই  ভরসা  রাখছি ।

-এই চিন্তা অসুর চিন্তা । নাস্তিক চিন্তা । যা প্রকৃতির বিপরীত , তাকে  নিয়ে সমাজে                    মানব সম্পদের উন্নয়ন সম্ভব নয় ।
-কেন  সম্ভব নয় ? আমাদের পথ আলাদা । আমি কখনই বলিনি নাগরিকদের  বিকাশের থেকে সরে আসব । আমি বলছি , তাদের  উন্নয়নের পরিমাপ  হবে শাসকের  পারগতা  সে অপারগ হলে  শাসন  চলবে  কেমন  করে ? অনেকে অনেক  কিছু চাইবে , সমস্যা  হচ্ছে সেই   চাওয়ার নিয়ন্ত্রণ নাগরিকদের হাতে থাকবার  দরকার  আছে  কি  ?
-আকাঙ্খার গোলক ধাঁধায় ঘুরবে !
-মানুষের ভূমিকাকে স্বীকার না করলে , মনের বিকাশ ঘটবে না । সৃষ্টি থেমে যাবে ।  মহাকালেশ্বর তথ্যে – পৃথিবীর সেই  বিপদের কথাই বলতে  চেয়েছি ।
-আমি সব জেনেছি , তাই আপনাকে আমার দলে আসবার জন্য অনুরোধ  করছি । 
-মানে  ?
-আপনি  খুব  বিদ্ব্যান  আর  পণ্ডিত  । এত গুপ্ত  বিষয়  নিয়ে   গবেষণা  করে  চলেছেন । সফল  হয়েছেন , এইটুকু অন্তত  বুঝে গিয়েছেন যে   আপনার  এই  গবেষণা  আমার  কাছে  স্বর্গরাজ্য  দখলের  চেয়েও  বেশী  গুরুত্বপূর্ণ । কেননা , মানুষের   মধ্যে  কর্তৃত্ব  করবার  মজাই  আলাদা ।  আসল  কথা  হচ্ছে , আমি চাইব  আপনি  এই  গবেষণার প্রয়োগ  না  করেন । কেননা  আপনার  শাসন  করবার  পদ্ধতি  মানুষ  গ্রহণ করবে  দ্রুত । আর  এমনটা  হলে , কেউ  আমাদের  গুরুত্ব দেবে  না । শুধু তাই  নয়  তাদের  দখল  করতে পারব না  । এমনটা  মানা  যায়না   তারা  বিদ্রোহ করতে  পারে ।
-জনগণকে  নিজের  সুবিধা  দেখতে  দেবেন না !
-সবাই  নিজেরটা  দেখে  , আমিও  দেখব ।
-আমিও দেখছি...
কিছুক্ষণ  দু’জনের  কণ্ঠস্বর  থেমে  গেল  । আমি  কিছু  বুঝতে পারছি না  । এতটুকু টের  পেলাম  ,  এতক্ষণ  যে  আমার  সাথে  কথা  বলছিলেন । তিনি কিছুটা  হলেও রেগে      রয়েছেন । আমাকে  বললেন – দেখুন  , আপনাকে   এইকথা  গুলো  বলবার  জন্যই  এখানে  আনা  হয়েছিল । চিন্তা  নেই  নিরাপদেই  যেখান থেকে  নিয়ে  এসেছিল  , সেখানেই  আপনাকে  ছেড়ে  দেওয়া  হবে    তবে  আজকের  পর  থেকে  নিজের  নগরের  দায়িত্ব  আপনি  নিলেন । আমি  কিন্তু   আপনার    দর্শনের  বিকল্প  রাখব ।  তখন  আমাকে  দোষ  দিতে  পারবেন না।  

চোখ  দুটো  কেউ  পুনরায় বেঁধে  দিল ! আমাকে নিয়ে  যাবে । 

গল্প শেষ হতেই  ,  পিতা  পুত্রদের  উদ্দেশ্যে  বললেন -   আমাদের  সজাগ  হওয়ার সময় এসেছে     কোন  ভাবেই  দূষণের  পরিকল্পনাকে  সফল হতে  দেওয়া  যাবে  না   
ছোট  ছেলে  বলল – পিতা  আপনি  বলুন  আমরা  কেমন  ভাবে  আদর্শ  নগরী  নির্মাণ করব ? জনগণের  জীবনে  স্বাচ্ছন্দ্য  দিতে  হলে  কোন  পথ  গ্রহণ করতে  হবে  ?
পিতা  হাসছেন ।  বললেন -  পুত্র ,  জনগণের  জীবনে    স্বাচ্ছন্দ্য   দিতে  গিয়ে  কোনদিনই  সফল  হবে  না    কেননা  বিনাপরিশ্রমে   কিছু  পেলে  ,  মানুষ অকর্মণ্য  হয়ে  ওঠে । সে  সমাজকে কিছুই  দিতে  পারেনা ।  মনে  রেখো  আদর্শ  নগরী  , আদর্শ  নাগরিক  তৈরী  করে । যে  নিজে  স্বনির্ভর ।   তাদের  ব্যবহারের  জন্য  উপযুক্ত  বাসস্থান ,   পোশাক  , খাদ্য  দিচ্ছ , অথচ  তাদের  জীবিকার  দিকে  খেয়াল  নেই , এমন উন্নয়ন  শুধু  মাত্র  শাসকপন্থী  উন্নয়ন ।  দূষণের  পরিকল্পনা  এমনটাই  ,  জনগণকে  কর্মবিমুখ  উন্নয়নের  স্বপ্নে  বিভোর  করে ,  নিজেদের  ক্ষমতা কায়েম রাখা  । এটা  সুস্থ  সমাজের  জন্ম দিতে  পারেনা ।


                      
গল্প  থেমে  গেলে ।  যিনি  এতক্ষণ  পিতা আর  পুত্রদের  গল্প  শোনাচ্ছিল ,  তুশ  থেমে  গিয়েছে  পাশে  বসে  থাকা  উল্টো  দিকের   লম্বা , রোগা   লোকটি  বৃকোদর  ভারী  গলায় বলে উঠল  -  তোমার  গল্প  শুনলাম ।  বেশ  ভালো ।
-শুধু  ভালো ?
-না  এটা  ঠিক ,  কাজ  না  করলে  মানুষ  অলস হয়ে ওঠে । আমি তাই  সবসময়  কাজের  পক্ষে । 
-অবন্তী  নগরীতে  খুব ঝামেলা  চলছে ।  যারা  এতদিন   পরিশ্রমের পক্ষে  ছিল , আজ  তারাই  বিদ্রোহ করছে ! তাদের  কথা    নগরের  প্রধানরা  তাদের   পরিবারের  দায়িত্ব  নিক ।   এতদিন  দেওয়া  -নেওয়ার মাধ্যমে  পরস্পরের  উপর নির্ভর  করতাম । এখন  বিদ্রোহীরা  বলছে  সম্পূর্ণ  জীবন  ধারণের  দায়িত্ব  নিতে  হবে  । শুধু তাই  নয়  তারা  ক্রমশই  নগরী  ত্যাগ  করছে ।
বৃকোদর বিশেষ  কিছু  বলল  না    হাই  তুলল । মাথা চুলকিয়ে  বলল 
-ভাই , আজ  উঠছি ।  জানিনা  আবার  কবে  দেখা  হবে  ?
তুশ  বেশ  কিছুটা   অবাক  হয়ে  বললেন -  কেন ?
ইতস্তত    মুখ  নিয়ে  বলল  -  আসলে  , কাল  খুব  ভোরেই  পরিবারকে  নিয়ে  অবন্তী ত্যাগ  করব ।
-কেন ?
- পাহাড়ের   ওইদিকে  এক  নতুন  নগর তৈরী   হচ্ছে । সেখানে   নাগরিকদের  সব  দায়িত্ব নগর  প্রধানের ।  নাগরিকদের  কোন  পরিশ্রম করতে  হবে  না 
-তাহলে  এমনি  -এমনিই ...
-না , মানে বদলে  নগর  প্রধানের  কথা  শুনে  চলতে  হবে    নিজের স্বাধীনতা  থাকবে , সেই  স্বাধীনতার  পরিমাণটাও  অবশ্য শাসকই   নির্ধারণ  করবে । এই  অনেক  রাত  হল  আসছি...


তুশ  দেখছে  , হেলতে  -দুলতে  তার  বন্ধু    ক্রমশই  জঙ্গলের ছায়া  মাখা    পথ  ধরে    এগিয়ে  চলেছে ।
 ছোট্ট  নিঃশ্বাস  ছেড়ে  তুশ  বলল -  মানুষ  শত  চেষ্টা  করলেও  নিজের  প্রবৃত্তির  কাছে  হেরে  যায় ! 
 =========০০০==========














পিনাকী চক্রবর্তী
যাদবপুর, কলকাতা
 

মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩