সভ্যতার পিলসুজ
অগ্নিদ্দীপ্ত সমৃদ্ধশালী সভ্যতার অট্টালিকাসম প্রত্যাশার নীচে ধ্বস
কুঁড়েঘরের ভাঙা চালে চাঁদের আলো।ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় পূর্নিমার
চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।বিলাসিতায় হুঁকোয় উড়ানো উল্লাসী ধোঁয়া উবে
যায়।পড়ে থাকে করতলগত দৃঢ়মুষ্টিতে পোড়া চিতাভস্ম ছাই দুটাকার বিড়ি।
ঠোঁটের ফাঁকে বিভাজিকায় নগ্ন খোলা হাওয়ায় সংসারের চাপ খানিকটা হ্রাস
পায়।চোখে তখন চালচিত্র ভাসে কুমারটুলীর মৃন্ময়ীর।আমার ঘরের লক্ষ্মী তখন
ব্যস্ত গোবরের ঘুঁটে দিতে হস্তপদ্মে পাঁক অশ্লীল না শুভ মহরৎ আমার
উদরপূর্তির আয়োজন।লৌহসম বজ্রদৃঢ় পেশী সাতমণ ভার সামঞ্জস্যে গাঁইতির কোপ
মাটির কোলে আঁচড়ে অন্ন ফলে।
কোমর অবধি কিংবা হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে ঠায় নিমগ্ন একাগ্রচিত্তে
মায়ের জরায়ুতে বীজধান রোপন দুইহাত দিয়ে কোমলচিত্তে পিতার বিশ্ব চরাচরে
তুমি পালনপিতা।ঠুনকো আরাম পরিত্যাগে কপালের ঘাম পায়ে ফেলে উদয়াস্ত কঠোর
পরিশ্রমে তোমার ভাগ্যের তালা খোলে।
দূর্ভাগ্যের কঠোর শানিত ঘায়ে পায়ের তলার জমি চলে যায়
অস্তাচলে।রবি তখন ফোঁটা ফোঁটা চোখের জলে ঝুপ করে ডুব অন্তহীন সমুদ্রে
তোমার যেন আত্মহত্যা।সামর্থ্যের দড়িতে দাঁড়িয়ে একপ্রান্ত থেকে
অন্যপ্রান্তে চলন্ত হুমড়ি খেয়ে নিষ্প্রদীপ আমার জীবনের জৌলুস।না নইলে নয়
টেনে হিঁজড়ে দিনযাপন আস্তাকুঁড়ে নগন্য ছাপোষা আমি যেন কোন নর্দমার
কীট।তবুও দুগ্ধপোষ্য সন্তান চোখের কোলে কুঞ্চন আগামী ভবিষ্যতে ও যেন হোক
সভ্যতার পিলসুজ।হ্যারিকেনের আলোয় চেয়ে আনা পুস্তকে হোক জাগ্রত অপদার্থের
আদ্যাক্ষর।
খননে খননে অন্ধকার গুহ্য অভ্যন্তর শুষ্ক সর্পিল সুড়ঙ্গ আমি
যেন কোন পাতালবাসী।গলা অবধি জল হাবুডুবু ওষ্ঠাগত তবুও আকাঙ্খার ভ্রূণ
টাকা চাই টাকা আরো মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।আমাকে তার পেছনে ছোটায়
হাঁপায়।টর্চের ক্ষীনায়মাণ দাঁড়ের মতন আলো আমাকে ডাকে বলে ওরে মাঝি পাল
তোল, নিজের নৌকা সামাল দে।অনিশ্চিত টালমাটাল পায়ে খরবায়ু বয় বেগে চারিদিক
ছায় মেঘে তবুও মালকোঁচা বেঁধে সম্মুখ সমরে ঝাঁপ আমি হারবো না।পরিশেষে সফল
তুমি হয়ে উঠো দৈহিক পরিশ্রমে সভ্যতার পিলসুজ।কয়লাখনি গর্ভে অবশিষ্ট চোখে
রৈখিক দেহপাত হীরক জ্বলজ্বলে শৌর্য তবুও দিনশেষে ভগ্নাংশ হাত পেতে
দিনমজুরী।দানা খুঁটে খাওয়া আমরা যেন জমিদারী সাতমহলায় ফাঁক ফোঁকড়ে
সহবাসরত ক্ষণিকের আলাপন কপোত কপোতী।
স্বামী চলে গেছে বহুদিন কোন খোঁজখবর নেই আমাকে একলা ফেলে
দিয়ে।তবুও বয়ে চলেছি তোমার প্রণয় ঋণ সিঁদুর।চোখের কোণে বালি কামড়ে জল
লুকিয়ে দুধেলা বাচ্ছাদের সামনে ফুটো ট্যারাবাঁকা চাঁদ টিনের এঁটো থালা
চকচকে।একমুঠো চেয়ে আনা মুড়ি শুধু জল দিয়ে ভিজিয়ে গৃহে দিয়েছি তালা, তোরা
আমার ভবিষ্যতের বন্ধকীপণ।কি করে আর কে ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি
স্বর্ণালী ভবিষ্যতে।
আমি যাই ঝাঁকামুটো মাথায় চাপিয়ে ক্রোশের পর ক্রোশ পায়ে হেঁটে
শারীরিক স্বস্তি চুলোয় দিয়ে পাথর খননে।আঁচলের লাট কোমরে জড়িয়ে বুকের
মাঝে সৌন্দর্য শতদল লুকিয়ে খটখটে রৌদ্রে সোনার বর্ণ ও গড়ন পুড়িয়ে আমি
আজ এক দগ্ধ শ্রমিক।তোমাদের ফ্যাশানদুরস্ত তুলতুলে নেলপালিশ হাত আজ
ক্রমাগত হাতুড়ি ও বর্শায় পাথর খননে লৌহসম বজ্রদৃঢ় মুষ্ঠি।সুন্দরী তোমার
হাত আজ আমার কাছে জীবাশ্ম।আজকে ওসব আমাকে মানায় না।তবুও ঠাকুরের পায়ে নমন
শীষ বুকের দুধ শুকায় না।ঘর পৌঁছাতেই নিষ্পাপ কচিকাঁচা স্তনের বোঁটা
কামড়ে ধরে অণ্বেষনে ক্ষীরোদ সাগর।
হাতের চেটোয় কড়া দাগ খসখসে কোমল অনুরাগ।আজ শুধু কানের
কাছে ঘ্যাঁনঘ্যাঁন গাঁইতি কোদালের আওয়াজ কিংবা যান্ত্রিকতার ঘর্ষণ
প্যাঁচের শব্দ।কানে তালা বিকলাঙ্গ আমার শ্রবণ।তাই ফোনে সাময়িক বিরতি ও
বিরাম কিংবা ওর গান ও রিংটোন আমার সহযাত্রী " এই পথ যদি না শেষ হয় তবে
কেমন হতো তুমি বলোতো।যদি পৃথিবী টা স্বপ্নের দেশ হয় তবে কেমন হতো তুমি
বলোতো।" তবুও যখন অকস্মাৎ বিনা মেঘে বজ্রাঘাত দুঃস্বপ্ন নৈঃশব্দে তার
রেখাপাত জাঁকজমক কারখানায় ঝোলে তালা লকআউট।গলাফাটা চীৎকারে অধিকারের দাবী
বজ্রদ্দীপ্ত কন্ঠে উঁচিয়ে দৃঢমুষ্টি তোমাদের একতা শ্রমদিবস কিংবা বনধ
আমাদের দাবী মানতে হবে।
তুমিও তো ঠাকুর নিষ্প্রদীপ হাত, পা ও কবন্ধ কাটা দশচক্রে
ভূত।তেলা মাথায় তেল ঠুঁটো জগন্নাথ কানে দিয়েছো তুলো করোনা কর্ণপাত
একেবারেই উদাসীন আমাদের প্রতি তুমি একচক্ষু।তাইতো ভাঙা আমাদের
শিড়দাঁড়া।তবুও যখন মনে মনে ভাবি তখন আমার ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসি।তুমিও
তো তৈরী শিল্পনৈপুন্যে শ্রমজীবি মানুষের হাতে।তবেই তো তোমার বেঢ়প
মৃত্তিকায় আঙ্গিক ষোলআনা পূর্ণ চন্দ্রকলা অস্তিত্ব সভ্যতার পিলসুজ।
বার্ধক্যের কোঁচকানো চামড়া কম্পিত হাতের আঙুল তবুও কমেনি
তোমার মনের জোর।এখনো কাজের ডাক এলেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলে যাও গাঁইতি
হাতে আমার গৌরব আমি শ্রমিক।ধমনীতে অশ্বের হ্রেষাগতি কিংবা দৌড় ললাটে
তোমার অশোক চক্র।ঘূর্নায়মান চাকার দন্ডে হিড়হিড় করে শ্রমে আনবেই
সভ্যতার অগ্রগতি তোমরাই তো সভ্যতার পিলসুজ।চাকার তলায় পেষণ প্রতিবন্ধকতার
প্রস্তর ভেঙে খান খান হয়ে যায় ধূলো।পুঞ্জীভূত ক্ষোভ রিক্ত হস্তে নেই কোন
কলমের জোর শুধু পুঁজি তোমার দৈহিক আগ্নেয়গিরি।
মুষ্ঠিবদ্ধ কামারশালার আঁচ জ্বলন্ত চুল্লীর ছাঁচ
দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ।
দুমুঠো ভাতের যোগানে ছন্নছাড়া বিলাসী যৌবন শ্রমের শৃঙ্খল করাঘাত শাসক
তোমার কপালে চরম বজ্রপাত দিন তোমার ঘনিয়ে আসছে।
নায্য পাওনা দুমড়ে মুচড়ে হাত কেড়ে নিয়ে জ্বালাতে চাও মশাল সভ্যতার পিলসুজ।
শুধু দিনশেষে উড়ো পাখির ঘরের চৌকাঠে মাথা নীচু আশ্রয়
ফিরিস্তী সাধ ও সাধ্যোর লক্ষ্মীর পাঁচালী
ঝাঁপির গহীনে লুকানো একটুকরো স্বর্নালী সন্ধ্যার অলংকার।
স্রোতসিনীর উদ্দাম মাতাল স্রোতে ঠেক "তুমি কষে ধরো হাল আমি তুলে বাঁধি পাল,
হাঁই মারো মারো টান হাঁইয়ো,,,, হাঁইয়ো।
সন্ধ্যের ফুটন্ত গোলাপ লালিমা সীমান্তে লক আউট লক্ষ্মনের নিষিদ্ধ গন্ডী।
ভাতের ঝুরো ঝুরো ক্রন্দন চাপা দীর্ঘশ্বাস
পরিশ্রম চোখের বালি।
চাকার দন্ডের পর দন্ডে ঘূর্নায়মান মস্তিষ্ক স্বপ্ন বোনে কেন্দ্রের অভিকর্ষের টান
কিন্তু ভেঙে খানখান সকল উচ্চকিত সোপান।
শ্রম তোমাদের চোখে মুখে দীর্ঘায়িত কোঁচকানো বলিরেখা নৈব নৈব চ।
ইটভাঁটার গনগনে আঁচ মাথায় বোঝাই এক থাক দু থাক ইঁটের সিঁড়ির চাপ।কোলে
ঝুলন্ত যেন কোন বাদরের বাচ্ছা।দুগ্ধপোষ্য সন্তান আঁকড়ে ধরেছে স্তনবৃন্ত
অন্তর্বাসে আটকে নেই দুধের মুক্তি।তবুও ছোট চোখের দানা চিকচিক অস্ফুট
আবেগ।মায়ের কাছেই আছি আমি সুরক্ষিত।দরদর করে ঘর্মের জলপ্রপাত দৈহিক
আঙ্গিকে সিক্ত অজন্তার সৌকর্য।উদয়াস্ত পরিশ্রমে সোনার দহন কুন্দনে অলংকার
শোভা।হাতে কটা টাকা মন খোলা হাসি দিনশেষে এবার তাহালে রাতে জুটবে ভিজে
ভাত সাথে কাঁচা পেঁয়াজ ও পরিশ্রমের ঝাঁঝ লঙ্কা।আমার ছোট সংসার আমি ও আমার
ছেলে।হয়ত ভাবি দুচোখের পাতা বুজে রাতে প্রোমোটারের কর্তৃত্বে হবে আমার
জোগানো ইঁটে অট্টালিকা বা ফ্ল্যাট।কিন্তু থাকবে না সেখানে আমার নামের কোন
স্বীকৃতি।আমি শুধু নামধামহীন ইটকাঠে গড়া হাড় কঙ্কাল দৈহিক আগ্নেয়
শ্রম।দিনশেষে তোমরা যে যাই বলো আমিই সভ্যতার পিলসুজ।
=====================================================
সুপ্রীতি বর্মন।
সুভাষপল্লী, কালীতলা।
পোষ্ট+জেলা: বর্ধমান।
খুব ভালো লাগলো । অনুভূতির রসায়ন কীভাবে মুকুলিত হয় তা দেখলাম।
উত্তরমুছুন