প্রবন্ধ ।। বাংলা যাত্রা ও নাট‍্যশিল্পে অবক্ষয় ।। মাখনলাল প্রধান - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

Sunday, July 20, 2025

প্রবন্ধ ।। বাংলা যাত্রা ও নাট‍্যশিল্পে অবক্ষয় ।। মাখনলাল প্রধান

বাংলা যাত্রা ও নাট‍্যশিল্পে অবক্ষয়

মাখনলাল প্রধান


বাংলার শিল্প-সংস্কৃতির জগতে যাত্রা শিল্প তথা নাট‍্যশিল্পে মড়ক নেমে এসেছে । যাত্রা শিল্পের মড়কে শুধু কোভিড নয় তার বহুপূর্ব থেকেই অর্থনৈতিক বিপর্যয় , শিক্ষাক্ষেত্রে বন্ধ‍্যাত্ব এবং গ্ৰাম বাংলার পটপরিবর্তন শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে। যাত্রা-শিল্পের লীলাভূমি ছিল গ্ৰাম বাংলা। গ্ৰামে প্রচুর যাত্রাপালা হত নানা উৎসবকে কেন্দ্র করে । জমিদারি ব‍্যবস্থা লুপ্ত হওয়ার পর গ্ৰামীণ মানুষের উদ‍্যোগে শীতলা পূজা,  কালীপূজা, দুর্গাপূজা, কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা, চড়ক ইত‍্যাদিকে উপলক্ষ‍্য করে যাত্রাপালার আয়োজন না হলে কেমন যেন ম‍্যাড়ম‍্যাড়ে লাগতো। সেই সঙ্গে কলকাতার বড়বড় কোম্পানির যাত্রাপালা ঘটা করে, টিকিট সেল করে হত মাঠে। খুব বড় মাপের খেলার মাঠ যেখানে ছিল না সেখানে ধানের মাঠ নেওয়া হত ‌। ত্রিশ-চল্লিশ হাজার মানুষ দেখতে আসত। স্পেশাল বাস পাঠাত  আয়োজক কর্তৃপক্ষ। বিনা ভাড়ায় বাসে যাতায়াত করত যাত্রার দর্শকেরা। কিন্তু বিকল্প ধানচাষ শুরু হলে জমিগুলো সময় মতো ফাঁকা পাওয়া গেল না । প্রথম দিকে ব‍্যাপকহারে ধান শুরু না হওয়ায় খুব একটা অসুবিধা হত না। বহুক্ষেত্রে  ধান কাটার ফাঁকে শীতে হয়ে যেত যাত্রা। সীমিত হয়ে গেল যাত্রাপালার আয়োজন। ধানকাটার পর বেশি সময় পাওয়া গেল না। মানুষ চাষাবাদ নিয়ে ব‍্যস্ত হয়ে পড়ল । সময় সংক্ষেপের কারণে যাত্রার দলগুলোর অর্থনৈতিক ক্ষতির ফলে বহুকোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে।  কিন্তু এটাই সব কারণ নয়।
দ্বিতীয়ত শাসক ও শাসনের চরিত্রগত অভিব‍্যক্তি যে ক্ষেত্র রচনা করে তা বুঝিয়ে দেয় কীরূপ ফসল সে মাটিতে সম্ভব । পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা গেছে , সিংহাসনে বসলেই ব‍্যক্তির চরিত্র ধর্ম ভাষা বাক‍্য প্রয়োগ , প্রতিশ্রুতি , দেশপ্রেম , শিল্প ভাবনা সবই পাল্টে যায় । তিনি নিজেকে সর্বজ্ঞ , সর্বশ্রেষ্ঠ , সর্বনিয়ন্ত্রা বলে জাহির করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন ।  আদর্শগত সংঘাত শিল্প তথা সংস্কৃতিকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে । সর্বোপরি আত্মাভিমান এমন চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায় যে , জনগণকে  পুতুল করে , সংঘবদ্ধ অনুগ্ৰহভোগী সৃষ্টিতে নজর যখন  কাজ করে , শিল্পীদের অনেকেই অনুগ্রহ ভোগীর সুবিধা পেতে চেষ্টা করে । ফলে শিল্পে একটা মন্দা বা  ভাঁটার টান অদৃশ‍্যভাবে কাজ করে । দর্শক পেলে খায় না পেলে থমকায় । মনে পড়ছে প্রয়াত নাট‍্যকার উৎপল দত্তের ' টিনের তলোয়ার 'নাটকের একটি চরিত্র বীরকৃষ্ণ দাঁ বলছে  "  টাকার সামনে অমন অনেক বন্দুকের নল মাটির সঙ্গে মিশে গেছে কাপ্তেনবাবু । দু'হাতে আটটা  জড়োয়ার আংটি , এর যে কোনো একটা দিয়ে আপনাদের সব সাহিত্য-টাহিত‍্য কিনে নিতে পারি ।" এখন সেটাই হয়ে গেছে সংস্কৃতি জগতের কর্ণধার ।
'বোড়াল সংলাপ আমাদের ' নাট‍্যগোষ্ঠীর কর্ণধার সত‍্যজিৎ বোস সুন্দর বলেছেন ,  জনদরদী গণনায়কেরা  সিংহাসনে বসলেই দাঁত নখ গজিয়ে ক্রমশ তীক্ষ্ণ , সুদীর্ঘ ও অনমনীয় হয়ে ওঠে । তিনি সংস্কৃতি তৈরি করেন।
নাটক বা যাত্রা অবজেক্টিভ আর্ট  যা সরাসরি গণসংযোগ তৈরি করে , গভীর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম । ব্রিটিশ সরকার নীলদর্পণ , গজদানন্দ ও যুবরাজ প্রভৃতি নাটকের অভিনয় বন্ধ করেছিল শাসক বিরোধী কণ্ঠরোধ করার জন্য ।  দুর্নীতি ,  ভুলভ্রান্তি , ক্ষমতার আস্ফালন , অহংকার সতত জন বিরোধী  যা বাস্তববাদী নাট‍্যশিল্পের প্রধান উপকরণ । সবাই তো নন্দলাল নয় যে নাকে খত দিয়ে 'ব্রাত‍্যজন ' নাট‍্যমঞ্চ খুলবে।
পক্ষান্তরে সরকার যেখানে শতশত কোটি টাকা ক্লাব , পূজায় , কার্নিভালে ঢেলে দিচ্ছে ; শিল্পমেলার নামে , খেলার নামে হরিরলুট দিচ্ছে তার এককণা যদি গ্ৰুপ থিয়েটার ও যাত্রা সংস্থাগুলো পেত তারা বোধহয় বেঁচে যেত । অনাহারে , অনিদ্রায় , বিনা চিকিৎসায় ধুঁকতে ধুঁকতে মরছে শিল্পী ও তার পরিবার । আর আশ্চর্য বাঙালির চৈতন্য যে বেমালুম ভুলে গেল স্বপন কুমার , শান্তিগোপাল , বীণা দাশগুপ্ত , অরুণ দাশগুপ্ত ,  শেখর চট্টোপাধ্যায় , বেলা সরকার , স্বপ্না কুমারী - শতশত খ‍্যাতিমান  যাত্রা শিল্পী আর ছিল মঞ্চাভিনেতা । কোনো যাত্রা দল আর নেই । বহুরূপী , সুন্দরম প্রভৃতি যুগান্তকারী নাট‍্যগ্ৰুপ মুছে গেছে  , ছোটোগুলো বাদ দিলাম । হলগুলো ভেঙে গেছে , দলগুলো ছন্নছাড়া । যে হলগুলো আছে সেগুলো ধুঁকছে । খাবার সংগ্ৰহ করবে না  নাট‍্য অনুশীলন করবে ।  কুশীলবদের বেশিরভাগই   চাকরিজীবী নয় । তারা বেগার খেটে অভিনয় শিল্পকে ব়াঁচিয়ে রাখতে অক্ষম । সংকটময় পরিস্থিতিতে চলমান গণদর্পণকে রক্ষা করা শিল্পমনস্ক জাতির বড় কর্তব্য । এসব ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক সরকারের সহযোগিতা একান্ত জরুরি ছিল । যাত্রা শিল্পের স্বপনকুমার , বীণা দাশগুপ্ত , শেখর চট্টোপাধ্যায়েরা  ছিটেফোঁটা সরকারি স্নেহ পেয়েছেন । আজকে লোক শিল্পীরা কিছু কিছু কিছু পাচ্ছেন । তাহলে এরা কেন পেতে পারেন না?
পশ্চিমবঙ্গ নাট‍্য-অ্যাকাদেমির রেজিস্টার নাট‍্যদলগুলো তিন বছরে ১৮-৩৪টা হলশো করলে কর্তাভজা বড়ো গ্ৰুপ এক থেকে দু লাখ , ছোটোগুলো ৩০ -৫০ হাজার টাকা সরকারি অনুদান পায় । যা দিয়ে  এতগুলো কুশীলবের চা-বিস্কুটের ব‍্যবস্থাও চলে না ।  কেন্দ্রের এন এস ডি থেকে বছরে পাঁচ-ছয় লাখ টাকা পাওয়ার ক্ষেত্রে এত নিয়মাবলি মেনে চলা  খুব কঠিন। তার পর ইন্টারনেট, ডিজিটাল মাধ্যমের দৌলতে দর্শক আর লাইন দিয়ে টিকিট কেটে সময় খরচ করতে চায় না । রাত জেগে বহুদূর গিয়ে যাত্রা দেখা বোধহয় আর সহ‍্য হচ্ছে না । জনগণের নয়  শাসকের । তদুপরি খিচুড়ি শিক্ষা ব‍্যবস্থায় অদ্ভুত বাঙালি সমাজের আবির্ভাব ঘটছে যারা বাংলা পড়তে লিখতে পারে না । পথে ঘাটে হিন্দি গান করবে মস্তি করে । তারা বাংলা যাত্রা-নাটক দেখবে এমন স্বপ্ন না দেখাই মঙ্গল । আর বাংলা সিরিয়ালের জনপ্রিয়তা নেমে এসেছে বস্তিতে । কারণ বাঙালিদের শিক্ষা দীক্ষা যে রুচির পরিচয় দেয় সেটা বোধহয় সিরিয়ালেই মিলে যায় । সিরিয়ালের কুশীলবরা বেশিরভাগ অমেরুদন্ডী শ্রেণির হওয়ায়  টাকার স্বপ্নে তারা লাইন দিয়ে যাচ্ছে রাজনীতিতে আরও অনেক কিছু পূরণের জন্য।

শাসকের সংস্কৃতি চেতনার গভীরতা, ইচ্ছা, শিক্ষা, মাতৃভাষার প্রতি দায়বদ্ধতা এবং স্বার্থপরতা একটি ভাষা-সংস্কৃতি গোষ্ঠীর ভয়ংকর নিয়ামক। একই সময়ে তাকালে দেখি তামিল, তেলেগু, মারাঠি প্রভৃতি দক্ষিণি ভাষার নাটক ক্রমশ উন্নত হয়ে উঠছে। তাদের প্রতিটি নাগরিক মাতৃভাষা সচেতন এবং দায়বদ্ধ তখন  বাঙালি  উন্নাসিক হয়ে উঠেছে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা গ্ৰহণে, গান গাওয়ায়, সিনেমা দেখায়, সিরিয়ালের প্রতি সামান্য টানে ।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ,  বিদ্বেষ , গৃহহারা হওয়া , প্রলোভন , প্রতিশোধ , প্রতিরোধ  সর্বোপরি শাসকের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা গণমনে ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে । পলাতক সুবিধাবাদী মানুষ একাধিক গর্ত তৈরি রাখে । তারাই বাংলার সংস্কৃতিকে ভিন্নখাতে ঠেলে দিয়েছে । মুক্তমনের যাত্রা-নাটকের প্রতি ন‍্যূনতম আকর্ষণ-ভালোবাসা সমূহ বিনষ্ট করছে ।
যাত্রা শিল্প গ্ৰাম বাংলার কিশোর-যুব হৃদয়ে যে শিল্প প্রেরণা যোগাতো, একটা সুকুমার মনোবৃত্তির সঞ্চার ঘটাতো , খ‍্যাতির আকর্ষণ , জনপ্রিয়তা প্রভৃতির ভূমিকা নিয়ে ছিল , তার অভাবে বর্তমান যুবসমাজকে প্রেরণাহীন ধ্বংসাত্মক ভাবনার দিকে আকৃষ্ট করছে । স্বার্থপরতা, নীচতা , হীন চারিত্রিক ভোগ সর্বস্বতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে । একটা জীবন্ত কর্মক্ষেত্র বা পারে , একটা শুকনো পাঠাভ্যাস তা পারে না । যাত্রার অভিনয়, গা , পোশাক, মঞ্চসজ্জা, যন্ত্রের ব‍্যবহার, সাউন্ড সিস্টেম , আলোর অত‍্যাধুনিক কৌশল , মিউজিক সরঞ্জাম - এসব কিছুই গ্ৰাম‍্য জীবনে বিশ্বদর্শনের ভূমিকায় মঞ্চাসীন ছিল । একটা গভীর শ্বাস নেওয়ার , জীবনকে ফিরে দেখার সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত । বিনোদন বলে, গ্ৰাম‍্য অশিক্ষিত মানুষের জন্য মনোরঞ্জনের কথা বলে কেউ কেউ বিষয়টিকে হালকা করতে চেয়েছে । আজকাল শহরে বাজারে যা ঘটছে যা অশিক্ষিতের থেকে শতগুণ নোংরা । রামকৃষ্ণের সেই লোকশিক্ষার পাঠশালার অভাব একটা জাতিকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে তার প্রমাণ আজকের অমেরুদন্ডী  বাঙালি সমাজ। লম্পট , পলাতক , স্বার্থপর চারিত্রিক জনসমাজের শিলান‍্যাস ঘটিয়ে দিল যাত্রা শিল্পের অকাল মৃত্যু।

এই মুহূর্তে এই সুকুমার শিল্পকে বাঁচাতে চাই সংঘবদ্ধভাবে বৈপ্লবিক-আন্দোলন , যা আবার গণমনে নতুনভাবে শিল্পচেতনার মরা গাঙে যদি স্ফুরণ  ঘটাতে পারে । সঙ্গে সঙ্গে নাট‍্যগোষ্ঠী যদি উৎকৃষ্ট প্রযোজনার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালায় তাহলে এই শিল্পের মন্দা কাটতে পারে বলে মনে হয়। সংঘবদ্ধ প্রয়াস ও প্রচার , অভিনব প্রযোজনা কাম‍্য। চাই জনমনে সাড়া জগানোর মতো প্রযোজনা , যা এই মন্দাকে এক ধাক্কায় সরিয়ে নিতে সক্ষম।

==================
মাখনলাল প্রধান
সুকান্ত পল্লি, বড়াল
কল -৭০০১৫৪

No comments:

Post a Comment