গানের হাড়
শুভজিৎ দত্তগুপ্ত
বাঁকুড়া জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামে, ঘন বন ও খরস্রোতা নদীর মাঝখানে ছড়িয়ে ছিল অপার শান্তি। কিন্তু এক অমাবস্যা রাতের পর থেকে বদলে যায় সব। রাত পেরোলেই কোনো না কোনো পরিবার থেকে নিখোঁজ হয়ে যেত একটি গবাদিপশু, কখনো ছোটো শিশু। চারদিকে ছড়ায় আতঙ্ক—গ্রামবাসীরা ফিসফিস করে বলতে শুরু করে, "পিছনের জঙ্গলে নাকি কিছু একটা জেগেছে।"
রাজা ঘোষণা দিলেন—যে এই অজানা শক্তিকে রুখে দিতে পারবে, তাকে দেওয়া হবে এক বস্তা সোনা আর গ্রামের দায়িত্ব।
এই ঘোষণার পর বহু সাহসী তরুণ বনে ঢুকেছিল, কেউ ফিরল না।সে সময় গ্রামেরই দুই ভাই রবিন ও শমীক সামনে আসে। শমীক শহরে কাজ করত, হঠাৎ গ্রামে ফিরে এসে বলল, "এই সুযোগে আমরা দুজনেই ধনী হতে পারি। আমি রাজাকে গিয়ে বলি, আমি দৈত্য মেরেছি, তুমি আমার সঙ্গী।" কিন্তু রবিন রাজি হয় না। সে বলে, "প্রকৃতি নিজে কখনো কারো ক্ষতি করে না। ওখানে কিছু আছে, তবে সেটাকে ভয় দিয়ে নয়, বুঝিয়ে মীমাংসা করতে হবে।"
রবিন সেই রাতেই একাই রওনা দেয় জঙ্গলের দিকে। সঙ্গে নেয় নিজের ছোটোবেলার বাঁশি, এক কাঁসার ঘণ্টি আর একটা পুরোনো পুঁথি—যেখানে লেখা ছিল গোপন মন্ত্র।
রাত গভীর হলে রবিন পৌঁছায় নদীর ধারে। সেখানে সে দেখতে পায় এক অদ্ভুত দৃশ্য—নদীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক কুয়াশা-মাখা ছায়া, মানুষের হাড়ের গায়ে মোড়া, চোখদুটি জ্বলজ্বলে সবুজ। ঠিক তখনই পুঁথির এক প্রাচীন মন্ত্র স্মরণ করে রবিন। সে ধ্যানস্থ হয়ে বাঁশিতে সুর তোলে—নরম, মধুর, কিন্তু কেমন যেন বিষণ্ণ।
ছায়ামূর্তিটি এগিয়ে আসে, মুখ ফুটে বেরোয় ফিসফিস শব্দ—"মুক্তি... মুক্তি..."।
ঠিক তখনই পিছন থেকে কেউ রবিনকে মাথায় আঘাত করে। সে অচেতন হয়ে পড়ে।
পরদিন সকালে খবর রটে যায়—শমীক নাকি দৈত্যকে মেরে ফেলেছে। সে এক টুকরো হাড় নিয়ে গিয়ে রাজদরবারে হাজির হয়। বলে, "এই হাড় সেই দৈত্যের!" রাজা স্বর্ণমুদ্রা দেন, গ্রামের দায়িত্ব তার হাতে তুলে দেন।
তিন বছর কেটে যায়।
গ্রাম শান্ত। কিন্তু নদীর পাশে একটা কুয়াশা-ঢাকা অঞ্চল আজও কেউ পেরোয় না। কেউ জানে না, সেখানে চাপা পড়ে আছে এক ইতিহাস।
একদিন নদীর ধারে হাঁস চরাতে গিয়ে রাখাল ছেলে দেখল—এক কুকুর মাটি খুঁড়ছে। সেখানে সে দেখে এক অর্ধভাঙা কঙ্কাল আর একটি পুরোনো বাঁশি।
খেলাচ্ছলে ছেলেটি বাঁশিতে ফুঁ দেয়।
হঠাৎ বাতাস জমাট বাঁধে। কুয়াশার মধ্যে এক কণ্ঠস্বর—
"সুরে ছিল সত্যি লুকোনো,
ভাই দিল পিঠে কুঠার কোপ,
মিথ্যা বলল রাজসভা,
জীবন গেল নদীর কোলে!"
গ্রাম কেঁপে ওঠে। ছেলেটি ভয় পেয়ে খবর দেয় সবাইকে। রাজা নিজে এসে তদন্ত করেন। প্রমাণ মেলে—রবিনের নিখোঁজ হওয়ার রাত, তার পুঁথি, বাঁশি, সেই হাড়, সবই মিলিয়ে এক বিপজ্জনক ছক ভাঙে।
শমীক স্বীকার করে নেয় সব কিছু। তাকে রাজ্যছাড়া করা হয়।
রবিনের স্মৃতিতে নদীপাড়ে এক স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়। স্থানীয় লোকেরা বিশ্বাস করে—রাতে বাঁশির সেই সুর আজও ভেসে আসে কুয়াশার মধ্যে, আর অন্ধকারের বুক চিরে বলে ওঠে—"সত্য মরে না।"
(Shyam Bazar)
No comments:
Post a Comment