প্রবন্ধ ।। শ্রমিকের অধিকার ।। চন্দন দাশগুপ্ত - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

Sunday, July 20, 2025

প্রবন্ধ ।। শ্রমিকের অধিকার ।। চন্দন দাশগুপ্ত

শ্রমিকের অধিকার 

চন্দন দাশগুপ্ত

         এই নিবন্ধের পরিধিটি বিশাল। ভারতবর্ষের বিভিন্ন শ্রম- আইনানুসারে শ্রমিকদের বেশ কিছু অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে নেই, তাই শুধু কয়েকটি প্রধান উল্লেখযোগ্য বিষয়েই আলোকপাতের চেষ্টা করা যাক। 

          [১] কাজে নিযুক্ত হবার সময়েই প্রত্যেক শ্রমিক একটি নিয়োগপত্র [ পশ্চিমবঙ্গ দোকান ও সংস্থা আইন-১৯৬৩ -র অধীনে থাকা শ্রমিকেরা এক্স (X) ফর্মে ] পাবেন ।

          [২] (ক) জুট মিলে কর্মরত কোনও শ্রমিকের পাক্ষিক উপস্থিতি ১২ দিন হলে, তিনি বেতন ছাড়াও অতিরিক্ত ২০ টাকা পাবেন। 
               (খ) 'ঠিকা'-তে উল্লিখিত পরিমাণের চেয়ে বেশি চাপাতা সংগ্রহ করলে বাগিচা শ্রমিকেরাও নির্দিষ্ট নিয়মানুসারে অতিরিক্ত টাকা পাবেন। 

          [৩] (ক) ১০ বা তার বেশি শ্রমিক কাজ করেন, অথবা বিগত ১২ মাসের যেকোনও একদিন ১০ বা তার বেশি কর্মী ছিলেন ( সিনেমা হলের ক্ষেত্রে এটি ৫ জন )-- এমন সংস্থার প্রত্যেক শ্রমিক কমপক্ষে একটানা ৫ বছর কাজ করলে, কর্মজীবনের শেষে (অর্থাৎ অবসর নিলে, ছাঁটাই হলে, পদত্যাগ করলে বা সংস্থাটি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হলে) গ্র্যাচুইটি পাবেন। তবে কর্মরত অবস্থায় শ্রমিকের মৃত্যু হলে এই ন্যূনতম ৫ বছর কাজের শর্ত পূরণ না করলেও সেই শ্রমিকের নমিনি গ্র্যাচুইটি পাবেন। 
               (খ) এই গ্র্যাচুইটির পরিমাণ হবে প্রতি বছর কাজের জন্য সর্বশেষ বেতন অনুসারে ১৫ দিনের (ঋতুকালীন নিযুক্তির ক্ষেত্রে ৭ দিনের) বেতন।
               (গ) প্রত্যেক শ্রমিক তাঁর গ্র্যাচুইটির নমিনি--- কে বা কারা হবেন, তা নির্দিষ্ট ফর্মের মাধ্যমে নিয়োগকর্তাকে জানিয়ে দিতে পারবেন। 
               (ঘ) নিয়োগকর্তা যদি প্রাপ্য গ্র্যাচুইটি শ্রমিকের কাজ শেষ হবার ৩০ দিনের মধ্যে না দেন অথবা কম গ্র্যাচুইটি দেন, তাহলে সেই শ্রমিক অথবা ( শ্রমিকের মৃত্যু হলে ) তাঁর নমিনি সংশ্লিষ্ট কন্ট্রোলিং অথরিটির কাছে ( পশ্চিমবঙ্গে তিনি একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট লেবার কমিশনার ) অভিযোগ জানাতে পারেন এবং সেই আধিকারিকের আদেশে সন্তুষ্ট না হলে সেই শ্রমিক/নমিনি সংশ্লিষ্ট অ্যাপিলেট অথরিটির (পশ্চিমবঙ্গে তিনি একজন ডেপুটি লেবার কমিশনার) কাছে অভিযোগ জানাতে পারেন। গ্র্যাচুইটি দিতে দেরি হলে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক/নমিনি সুদও দাবী করতে পারবেন। 
                (ঙ) প্রাপ্য গ্র্যাচুইটির সর্বোচ্চ পরিমাণ হবে ১০ লক্ষ টাকা।

          [৪] ২০ বা তার বেশি শ্রমিক আছেন এমন সংস্থার প্রত্যেক স্থায়ী, অস্থায়ী ও ঠিকা শ্রমিক প্রভিডেন্ট ফান্ডের সমস্ত সুবিধা পাবেন।

          [৫] মহিলা শ্রমিকেরা সন্তান জন্মের আগের ১২ মাসে কমপক্ষে ৮০ দিন কাজ করলে মাতৃত্বকালীন সুবিধা পাবেন, যেমন :--
    (ক) সর্বোচ্চ মোট ২৬ সপ্তাহ মাতৃত্বকালীন ছুটি পাবেন, তার মধ্যে সর্বোচ্চ ৮ সপ্তাহ ছুটি প্রসবের আগে নিতে পারবেন,
    (খ) মাতৃত্বের জন্য মহিলা শ্রমিকেরা ৩৫০০ টাকা মেডিক্যাল বোনাস পাবেন। 

          [৬] প্রত্যেক শ্রমিক নিয়মানুসারে ছুটি পাবেন। বিভিন্ন আইনের অধীনে থাকা বিভিন্ন সংস্থার জন্য এই ছুটির নাম এবং পরিমাণও ভিন্ন। বাগিচা শ্রমিক আইন,১৯৫১ এবং কারখানা আইন, ১৯৪৮ অনুসারে, প্রতি ২০ দিন কাজের জন্য,  বাগিচা বা কারখানায় কর্মরত একজন পূর্ণবয়স্ক শ্রমিক পরের বছর ১ দিন সবেতন অর্জিত ছুটি পাবেন, তবে এজন্য তাঁকে আগের বছর কমপক্ষে ২৪০ দিন কাজ করতেই হবে। পশ্চিমবঙ্গ দোকান ও সংস্থা আইন, ১৯৬৩ -র অধীনে যেকোন দোকান, কমার্শিয়াল এস্টাব্লিশমেন্ট, হোটেল-রেস্টুরেন্ট এবং সিনেমা-থিয়েটারে কর্মরত শ্রমিকেরা নিম্নলিখিত ছুটি পাবার অধিকারী :--
   (ক) প্রতি বছরে ১৪ দিন পুরো বেতন সহ প্রিভিলেজ লিভ (এটি সর্বোচ্চ ২৮ দিন জমিয়ে রাখা যাবে),
   (খ) প্রতি বছরে ১৪ দিন অর্ধেক বেতন সহ সিক-লিভ ( এটি সর্বোচ্চ ৫৬ দিন জমিয়ে রাখা যাবে ),
   (গ) প্রতি বছরে ১০ দিন পুরো বেতনসহ ক্যাজুয়াল লিভ ( এটি পরের বছরের জন্য জমিয়ে রাখা যাবে না ),
   (ঘ) প্রতি সপ্তাহে একটানা দেড় দিন সবেতন ছুটি,
   (ঙ) মহিলা শ্রমিকেরা পাবেন আইনানুগ মেটারনিটি লিভ।

         [৭] (ক) প্রত্যেক শ্রমিকের যেকোনও রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য হবার অধিকার থাকবে।
             (খ) কোনও সংস্থায় যদি একাধিক ট্রেড ইউনিয়ন থাকে, এবং সেখানে যদি "স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন" নির্ধারণের জন্য নির্বাচন হয়, তাহলে সেই সংস্থায় কর্মরত প্রত্যেক শ্রমিকের ভোটাধিকার থাকবে।

         [৮] কাজের বিনিময়ে প্রত্যেক শ্রমিক মজুরি/বেতন পাবেন। এই বেতন দৈনিক/সাপ্তাহিক/পাক্ষিক/ মাসিক হিসেবে দেওয়া যাবে, কিন্তু এর বেশি সময়-সীমার (যেমন দ্বিমাসিক/ত্রৈমাসিক প্রভৃতি) জন্য দেওয়া যাবে না।

         [৯] প্রতিদিন ৮ ঘন্টার বেশি কোনও শ্রমিক কাজ করতে বাধ্য নন। তার বেশি কাজ করাতে হলে সেই শ্রমিক-কে ওভার টাইম রেটে (অর্থাৎ স্বাভাবিকের দ্বিগুণ হারে) মজুরি/বেতন দিতে হবে।

         [১০] কাজের মাঝেই শ্রমিকেরা সুনির্দিষ্ট নিয়মানুসারে বিশ্রাম নেবার সুযোগ পাবেন।

         [১১] কাজের সময় এবং বিশ্রামের সময়ের যোগফলকে বলা হয় "স্প্রেড ওভার"। এই স্প্রেড ওভারের সর্বোচ্চ সীমাও বিভিন্ন আইনে সুনির্দিষ্ট । অর্থাৎ কাজ না করিয়েও কোন শ্রমিক-কে ঐ স্প্রেড ওভারে উল্লিখিত সর্বোচ্চ সময়ের চেয়ে বেশীক্ষণ কর্মক্ষেত্রে আটকে রাখা যাবে না।

         [১২] ন্যূনতম মজুরি আইন,১৯৪৮-এ নোটিফাইড শিল্প ও কাজের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক সমুচিত সরকারের ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি বা তার চেয়ে বেশি মজুরি পাবেন।

         [১৩] ১০০০ এর কম শ্রমিক কাজ করেন এমন সংস্থায় প্রতি মাসের ৭ তারিখের মধ্যে, এবং ১০০০ ও তার বেশি শ্রমিক কাজ করেন এমন সংস্থায় প্রতি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে শ্রমিকেরা পূর্ববর্তী মাসের বেতন পাবেন।

         [১৪] বিপজ্জনক কাজে নিযুক্ত শ্রমিকেরা অবশ্যই কাজের সময় উপযুক্ত সুরক্ষা-সামগ্রী পাবেন।

          [১৫] কারখানায় কর্মরত শ্রমিকেরা যাতে উপযুক্ত স্বাস্থ্যকর পরিবেশে "বসে" কাজ করতে পারেন এবং উৎপাদন ঠিক রেখে কাজের ফাঁকে বসে বিশ্রাম নিতে পারেন সেই ব্যবস্থা রাখতে হবে।

          [১৬] একই কাজের জন্য মহিলা ও পুরুষ শ্রমিকেরা সমান মজুরি পাবার অধিকারী।

          [১৭] বাগিচা শ্রমিকেরা নিয়োগকর্তার কাছ থেকে বেতন ছাড়াও বিনামূল্যে বাসস্থান ও চিকিৎসা পরিষেবা পাবার অধিকারী। তাছাড়া তাঁদের ছয় বছরের কম বয়েসী শিশুদের জন্য নিয়োগকর্তা সুনির্দিষ্ট মান এবং সুযোগ সুবিধা যুক্ত ক্রেশ রাখতে বাধ্য। তাছাড়া এই বাগিচা শ্রমিকেরা এবং কারখানা-শ্রমিকেরা নিয়োগকর্তার কাছ থেকে পানীয় জল এবং ক্যান্টিনের সুবিধে পাবার অধিকারী। বাগিচায় কর্মরতা মহিলা শ্রমিকেরা পূর্বে উল্লিখিত মেটারনিটি বেনিফিট অবশ্যই পাবেন। তাছাড়া চা- শ্রমিকেরা নির্দিষ্ট সময় পর পর পাবেন---তৈরি-চাপাতা, ছাতা, চটি, কম্বল, এপ্রণ, আর চা-পাতা তোলার রুমাল/ঝুড়ি। যেসব শ্রমিক বাগিচায় কীটনাশক স্প্রে করেন, তাঁদের নির্দিষ্ট সময় পর পর নিয়মিত ভাবে নিয়োগকর্তার খরচে শারীরিক পরীক্ষা করাতে হবে। বাগিচা শ্রমিকদের সন্তানদের স্কুলে যাবার জন্য মালিকপক্ষ প্রয়োজনীয় গাড়ির ব্যবস্থাও করে দেবেন।
        বাগিচার ডাক্তার যদি কোনও শ্রমিক-কে 'অসুস্থ' ঘোষণা করেন, তাহলে কাজে যোগ না দিলেও সেই শ্রমিক "সিক-হাজিরা" ( যা প্রকৃত হাজিরার দুই তৃতীয়াংশ ) পাবার অধিকারী।

          [১৮] ভবন এবং অন্যান্য নির্মাণ শ্রমিকেরা এবং ঠিকা শ্রমিকেরাও কর্মক্ষেত্রে বাসস্থান, সুরক্ষা ব্যবস্থা ও চিকিৎসার সুযোগ পাবার অধিকারী।

          [১৯] (ক) কারখানায় কর্মরত পুরুষ ও মহিলা শ্রমিকেরা আলাদা শৌচাগার ব্যবহারের অধিকারী।
                  (খ) জুট মিলের শ্রমিকেরাও বিনামূল্যে বাসস্থান পাবেন অথবা চুক্তি মোতাবেক বাড়ি ভাড়া ভাতা পাবেন।

          [২০] কোনও শ্রমিককে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে বরখাস্ত করা বা অন্য কোনও শাস্তি দেওয়া যাবে না।

           [২১] সংশ্লিষ্ট মীমাংসা আধিকারিকের সম্মতি না পেলে কোনও ট্রেড ইউনিয়নের পদাধিকারী-কে বরখাস্ত করা যাবে না।

           [২২] কয়েকটি শর্ত পূরণ হলে (সংস্থায় কমপক্ষে ২০ জন কর্মী থাকা, বছরে ন্যূনতম ৩০ দিন কাজে যোগদান......এমন কয়েকটি) প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ২১০০০ টাকা বেতন পান এমন শ্রমিকেরা বোনাস পাবেন। বোনাসের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন পরিমাণ হবে যথাক্রমে শ্রমিকের বার্ষিক আয়ের ২০% এবং ৮.৩৩% । তবে এই বোনাসের পরিমাণ হিসাব করা হবে শ্রমিকের প্রকৃত মাসিক আয় এবং ৭০০০ টাকা---এই দুটির মধ্যে যেটি কম, তার ওপর ।

           [২৩] কোনও শ্রমিক যদি সাসপেন্ড হন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত প্রক্রিয়া চলাকালীন, প্রথম ৯০ দিন তিনি অর্ধেক বেতন পাবেন এবং ( যদি তদন্তে বিলম্বের জন্য সংশ্লিষ্ট শ্রমিক দায়ী না হন তাহলে ) ৯১তম দিন থেকে তদন্তের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আগেকার বেতনের ৭৫% পাবেন। 

           [২৪] শ্রমিকেরা তাঁদের ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে তাঁদের সমস্ত দাবীদাওয়া সংশ্লিষ্ট মীমাংসা আধিকারিক (Conciliation Officer) এর কাছে উত্থাপন করতে পারেন এবং সেই মীমাংসা কার্যক্রম চলাকালীন মালিকপক্ষ সেইসব শ্রমিকদের চাকরির কোনও শর্ত বদলাতে পারবেন না।
        তবে, কোনও শ্রমিক -কে বরখাস্ত করলে তিনি নিজে অথবা তাঁর ট্রেড ইউনিয়ন সংশ্লিষ্ট মীমাংসা আধিকারিকের কাছে শিল্প বিরোধ (Industrial dispute) উত্থাপন করতে পারবেন।
 
           [২৫] যেকোনও কারখানায় মহিলাদের রাতে নিয়োগ এবং জুটমিলের বিশেষ কিছু কাজে মহিলাদের নিয়োগ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। 

           [২৬] কোনও কারখানা/সংস্থা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিলে অথবা কোনও শ্রমিক ছাঁটাই হলে, সেই শ্রমিক প্রতি বছর কাজের জন্য গ্র্যাচুইটির  সর্বশেষ প্রাপ্ত বেতন অনুসারে ১৫ দিনের বেতন ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাবার অধিকারী। অর্থাৎ, কারখানা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে, ১০ বছর ধরে কর্মরত একজন শ্রমিক ১৫×১০=১৫০ দিনের বেতন (সর্বশেষ প্রাপ্ত বেতনের হারে) পাবেন।

           [২৭] কাঁচামাল না পাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ,  অতিরিক্ত উৎপাদিত পণ্য জমে যাওয়া, বিদ্যুতের অভাব প্রভৃতি কারণে ( যেগুলি নিয়োগকর্তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে ) যদি কোনও নিয়োগকর্তা তাঁর কর্মীদের কাজ দিতে না পারেন,  তাহলে তিনি নিজের সংস্থাতে কিছু শর্তসাপেক্ষে "কামবন্দী" বা "লে-অফ" ঘোষণা করতে পারেন। এই লে-অফ চলাকালীন কিছু শর্তসাপেক্ষে শ্রমিকেরা কাজ না করতে পারলেও অর্ধেক মজুরি/বেতন পাবার অধিকারী।

          [২৮] পশ্চিমবঙ্গ দোকান ও সংস্থা আইন, ১৯৬৩ এর অধীনে থাকা কোনও শ্রমিকের যদি বেতন সম্পূর্ণ বা আংশিক কেটে নেওয়া হয়, তাহলে তা উদ্ধারের জন্য সেই শ্রমিক সংশ্লিষ্ট শ্রম- আধিকারিকের কাছে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে আবেদন করতে পারেন।
       অন্যান্য শ্রমিকেরাও প্রাপ্য বেতন না পেলে সংশ্লিষ্ট শ্রম আধিকারিকের কাছে ব্যক্তিগত ভাবে বা ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে অভিযোগ জানাতে পারেন।

        
           [২৯] পশ্চিমবঙ্গ শ্রমিক কল্যাণ তহবিল আইন, ১৯৭৪ --এর অধীনে থাকা শ্রমিকেরা বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা (যেমন খুব কম ভাড়ায় দীঘা, বকখালি, পুরী, দার্জিলিঙ, গ্যাঙটকের হলিডে হোমে থাকা, বিভিন্ন ধরণের কর্মমুখী ট্রেনিং, সন্তানদের পড়াশোনার জন্য স্কলারশিপ, বিভিন্ন খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ  প্রভৃতি) পাবার অধিকারী।

           [৩০] কর্মচারী রাজ্য বীমা (Employees State Insurence) -- এর অধীনে থাকা শ্রমিকেরা চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পাবেন। 

           [৩১] কাজ করাকালীন কোনও শ্রমিকের দুর্ঘটনা ঘটলে, অঙ্গহানি বা মৃত্যু হলে এমপ্লয়িজ কমপেনসেশন (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট,২০১৭ অনুসারে তিনি বা তাঁর নমিনি উপযুক্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাবার অধিকারী।

          [৩২] কোনও সংস্থার মালিকানা বদল হলে শ্রমিকেরা পুরনো মালিকের কাছ থেকে সমস্ত বকেয়া গ্র্যাচুইটি এবং ছাঁটাই বাবদ প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ পাবেন, অথবা নতুন মালিক-কে সমস্ত শ্রমিকের কাজ "নিরবচ্ছিন্ন(continues)" ঘোষণা করে তাঁদের সমস্ত বকেয়া পাওনা যথাযথ পরিশোধের দায়িত্ব নিতে হবে।

          [৩৩]  যেকোন জাহাজঘাটা বা ডকে এবং খনিতে কর্মরত পুরুষ শ্রমিকেরা কখনই ৩৫ কিলোগ্রামের বেশি আর মহিলা শ্রমিকেরা ২৫ কিলোগ্রামের বেশি ওজন বহন করবেন না। তাছাড়া ডকে কোনও মহিলা শ্রমিক-কে রাতে কাজ করানো যাবে না এবং খনিতে ( ভূগর্ভে) কখনই কোনও মহিলা শ্রমিক-কে নিয়োগ করা যাবে না।

           [৩৪] পশ্চিমবঙ্গে কোনও কারখানা ও চা-বাগান কমপক্ষে ৫ বছর একটানা চলার পর যদি যথাক্রমে ৬ মাস ও ১ মাস একটানা বন্ধ থাকে, তাহলে বন্ধ হবার আগে অন্তত ১ বছর একটানা কাজ করেছেন, এমন শ্রমিকেরা ( যদি তাঁরা গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা অথবা ছাঁটাই বাবদ প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ না পেয়ে থাকেন ) পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ  থেকে FAWLOI  (Financial Assistance for the Workers of Locked Out Industries) স্কিমের মাধ্যমে প্রতি মাসে ১৫০০ টাকা এবং দূর্গাপূজা/ঈদের আগে এক্স-গ্রাসিয়া হিসেবে আরো ১৫০০ টাকা আর্থিক সাহায্য পাবার অধিকারী। এই আর্থিক অনুদান শ্রমিকেরা পাবেন  ৫৮ বছর বয়স অথবা সেই সংস্থার শ্রমিকদের প্রকৃত অবসরের বয়স (অনধিক ৬০ বছর) পর্যন্ত। শ্রমিকের মৃত্যুর পর একই আর্থিক অনুদান তাঁর নমিনি পাবেন যতদিন বেঁচে থাকলে সেই শ্রমিক পেতেন। বন্ধ সংস্থার ক্ষেত্রে, সংস্থাটি খোলার পরবর্তী ২ মাস পর্যন্ত এবং বন্ধ চা-বাগানের ক্ষেত্রে, সেটি খোলার মাস পর্যন্তই সংশ্লিষ্ট শ্রমিকেরা এই আর্থিক সাহায্য পাবেন। 

          [৩৫] পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী, ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়েসী নির্মাণ শ্রমিক, মোটর পরিবহণ শ্রমিক এবং অন্যান্য বিভিন্ন অসংগঠিত ক্ষেত্রে ও স্বনিযুক্ত কাজে নিযুক্ত শ্রমিকেরা "বিনামূল্যে সামাজিক সুরক্ষা যোজনা" প্রকল্পে নাম নথিভুক্ত করতে পারেন। এর মাধ্যমে তাঁরা বেশ কিছু সুবিধা ভোগের অধিকার লাভ করবেন, যেমন :--
    (ক) স্বাভাবিক মৃত্যুতে এককালীন ৫০ হাজার টাকা এবং দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুতে এককালীন ২ লক্ষ টাকা পাওয়া যাবে,
    (খ) শারীরিক অক্ষমতা দেখা দিলে, গুরুত্ব অনুসারে ৫০ হাজার থেকে ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত পাওয়া যাবে,
    (গ) প্রত্যেক শ্রমিকের জন্য ভবিষ্যনিধি ফান্ডে (Provident Fund) সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি মাসে ৫৫ টাকা জমা রাখা হয়, যা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদসহ শ্রমিক-কে ৬০ বছর বয়স হলে দেওয়া হয় অথবা তার আগেই তাঁর মৃত্যু হলে তাঁর নমিনির হাতে দেওয়া হয়। হিসেব করে দেখা গেছে, ১৮ বছর বয়েসে একজন অসংগঠিত শ্রমিক নাম নথিভুক্ত করলে, ৬০ বছর বয়েসে তিনি আড়াই লক্ষাধিক টাকা পাবেন, 
    (ঘ) ৬০ বছর বয়স হলে ( ন্যূনতম ৫ বছর নথিভুক্ত থাকার পর ) একজন পরিবহণ শ্রমিক সারা জীবন ধরে প্রতি মাসে কমপক্ষে ১৫০০ টাকা পেনশন পাবেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্বামী/স্ত্রী সারাজীবন ৫০% টাকা পারিবারিক পেনশন পাবেন। প্রতি ১ বছর বেশি নথিভুক্ত থাকলে ১০ টাকা হিসাবে পেনশন বেড়ে যাবে। ঠিক একই নিয়মে নির্মাণ শ্রমিকেরাও পেনশন এবং পারিবারিক পেনশন পাবেন, তবে তাঁদের ন্যূনতম পেনশন হবে ১০০০ টাকা।
     (ঙ) নির্মাণ এবং পরিবহণ শ্রমিকেরা ৪০% বা তদূর্দ্ধ স্থায়ী শারীরিক অক্ষমতা সৃষ্টি হলেও পুরো পেনশন পাবেন। 
 
        শেষ কথা :---প্রথমেই বলা হয়েছে, শ্রম আইনের পরিধি বিশাল। এতক্ষণ শুধু মূল কয়েকটি বিষয় আলোচনা করা হল। অধিকাংশ আইনেই শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে নানা ধারা/উপধারা যেমন আছে, তেমনি আছে বিভিন্ন ধরণের শর্ত, এবং ছাড় বা exemption,  যার বিস্তারিত বর্ণনার সুযোগ এখানে নেই। তবুও এই রাজ্যের ও দেশের সাধারণ মানুষের যদি এই নিবন্ধ সামান্যতম কাজেও লাগে, তাহলেই আমার প্রচেষ্টা সার্থক। 
                      
======================
চন্দন দাশগুপ্ত 
( অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত শ্রম কমিশনার, 
  পশ্চিমবঙ্গ সরকার )
৩০/১/সি, রামকৃষ্ণ উপনিবেশ, রিজেন্ট এস্টেট, 
কলকাতা---৭০০ ০৯২


No comments:

Post a Comment