গল্প ।। শিকড়ের খোঁজে ।। সমীর কুমার দত্ত - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

Sunday, July 20, 2025

গল্প ।। শিকড়ের খোঁজে ।। সমীর কুমার দত্ত

শিকড়ের খোঁজ 

সমীর কুমার দত্ত 



দেশ ভাগ হয়ে গেলো। দেশের বড়ো বড়ো নেতারা কেউই দেশভাগ আটকাতে পারলো না। দেশ ভাগের প্রথম নয় বৎসরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে একুশ লক্ষেরও বেশি সংখ্যা লঘু নিপীড়িত হিন্দু , ভারতের বর্ডার ডিঙিয়ে বাস, ট্রেনের মাথায় চড়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল তথা পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম প্রভৃতি রাজ্যে ঢুকে পড়ে রেল‌ওয়ের দু পাশের জলাজমি সংলগ্গ এলাকায় যে যতটা পেরেছে জমি দখল করে হোগলার বেড়া দিয়ে অস্থায়ী গৃহ নির্মাণ করে বসবাস শুরু করে। পরবর্তী কালে যা কলোনির রূপ নেয়। এইরূপ একটা উদ্বাস্তু পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভিড়ের পিছন পিছন চলতে থাকে এক অষ্টম বর্ষীয় বালক। কিন্তু যখন সবার দ্বারা উপেক্ষিত হয়ে একা হয়ে পড়ে , তখন ওর সম্বিত ফেরে। আর তখনই ও কান্নায়  ভেঙে পড়ে। তার‌ই মধ্যে একটি ছোট পরিবারের বুড়ো কত্তা শীতল সরকারের  চোখে পড়া মাত্রই শীতল সরকার বলে, 
" আহা রে, পোলাডা কাঁদতাসে। ওর সঙ্গে কেউ নাই। পরিবারের থাইক্যা বিচ্ছিন্ন হ‌ইয়া পড়সে।" ছেলেটির কাছে এসে মাথায় হাত বুলতে বুলতে জিজ্ঞাসা করে, " এই পোলা, তর সঙ্গে কেউ নাই? তুই আইলি ক্যামনে?" 
— আপনাগো পিসে পিসে আইসি। বাবা মা'রে দ্যাখাতে পাই নাই। অনেকক্ষণ ধ‌ইরা খুঁজতে ছিলাম। না পাইয়া আপনা গো পিসে পিসে আইতে সিলাম কিন্তু পাইলাম না। গেলো কৈ?"
— তর বাড়ি কুথায় জানস?
—ঐ ময়মনসিংহ জিলায়।
—তর নাম কি ক তো।
—আমার নাম বিজয় দাশ।
—তর বাপের নাম কি ক।
—বাপের নাম সঞ্জয় দাশ।
—সঞ্জয় দাশ । ময়মনসিংহ। চেনা মনে হ‌ইতাসে না।(স্বগতোক্তি করে)  এক কাস কর , তুই এহন আমাদের কাসে থাক। আমি তর বাবা মা'র খোঁস 
করব। দেখি কুনো জানা শুনা পাই কিনা। কাঁদস না। খিদা পাইসে? 
— না, আমার বাবা মা'র কাসে যামু।
— যাবি তো ঠিক‌ই। চিন্তা করস ক্যান। এহন কয়খান বিস্কুট আসে খাইয়া ল।
বলে কয়েকটা  বিস্কুট বিজয়ের হাতে আর বাকি কয়েকটা নাতনির হাতে দিলো।

বুড়ো কত্তা শীতল সরকারের স্ত্রী বিভা তার স্বামীকে বলে, " কার না কার পোলা। ওরে ল‌ইয়া এত আদিখ্যেতা করণের কি আসে! অনেকেই দ্যাখসে , কেউ তো ওর দায়িত্ব ন্যায় নাই। তুমি আগ বাড়াইয়া ওর  দায়িত্ব নিতে যাও ক্যান? 
—কেউ স্বার্থপর হ‌ইতেই পারে কিন্তু আমি হ‌ইব ক্যান? একটা বাস্সা পোলা হারাইয়া গ্যাসে, আর আমি স্বার্থপরের মতো চোখ বুঝিয়া থাকুম? আর একখান কথা ক‌ই, তুমার সব ব্যাপারে কথা ক‌ওনের কি আসে। বাচ্চা পোলা বাবা মা'র কাস হ‌ইতে আলাদা হ‌ইয়া গ্যাসে, ওরে এখন ছাড়ান দেয়া যায়? যার পোলা সে নিশ্চয়ই খোঁস করবে। ভিড়ের লাইগ্যা আলাদা হ‌ইয়া পড়সে।

গিন্নির অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিজয় শীতল সরকারের ঘরে বেড়ে উঠতে লাগলো। তবে মন্দের ভালো ভাবে। দিন গড়িয়ে রাত, রাত গড়িয়ে দিন কেটে যায় কিন্তু ওর বাবা মায়ের দেখা মেলে না। যদিও শীতল সরকার চারিদিকে যেখানে উদ্বাস্তুরা এসে বসবাস করছে, সেখানে গিয়ে খোঁজ করেছে কিন্তু কেউই ওর বাবা মা'র  হদিস দিতে পারেনি। তাই এলাকার একটা স্কুলে বিজয় সরকার নামে ওকে ভর্তি করে দেওয়া হয়। কিন্তু তাতে কি? কিছুদিন পরেই স্ত্রী বিভার জন্য‌ই পড়া বন্ধ হয়ে যায়। স্বামীকে আটকাতে না পেরে,নিজে অপকর্ম করে তার শোধ নেয়। শীতল সরকারের মেয়ে মৌসুমী সন্তান প্রসবকালে মেয়ে সন্তান প্রসব করে মারা যায়। জামাই, কন্যা সন্তান জন্মানোর জন্য‌ই হোক আর এতটুকু বাচ্চা মানুষ করতে না পারার জন্য‌ই হোক, নবজাতিকার দায় নিতে অস্বীকার করে। সুতরাং  শীতল সরকারকে মেয়ের ঘরের নাতনির দায় নিজের কাঁধে তুলে নিতে হয়। একে দেশ ছাড়া হয়ে সবকিছু হারিয়ে পথের ভিখারি হয়ে পড়েছে। তার ওপর এই পিতৃ মাতৃ হারা নাতনিকে কী করে মানুষ করবে তার ঠিক নেই, তার উপর আবার এই আপদ এসে জুটেছে। স্ত্রী বিভা বিজয়কে আপদ বলেই মনে করে। তাড়াতে যখন পারেইনি , ওকে সংসারের বোঝা হয়ে থাকতে ও দেবে না। রাত দিন ফন্দি আঁটতে থাকে। 'একে মা মনসা, তায়ে আবার ধূনোর গন্ধ।' পাশের ঘরের ‌ব‌উ বিভাকে তাতাতে থাকে এই বলে,"  ওসব দায় ল‌ইতে গ্যালেন ক্যান? বিদেয় করেন,বিদেয় করেন সোট  থাকতে থাকতেই বিদেয় করেন। না হ‌ইলে পরে আর ভাগাইতে পারবেন না।"
উত্তরে বিভা বলে," আমি কি ওর দায় ল‌ইতে গেসি। আমার কত্তাডাই তো  ওরে ঘরে তুলসে।" 
তাই বিভা বিজয়কে আধপেটা খাইয়ে কিছু মাল দিয়ে রাস্তায় বসিয়ে দিয়েছে বিক্রির জন্য এই বলে, " আর পড়তে হ‌ইব না। খুব হ‌ইসে। খাবি কি? বাপ মা তো আপদ মনে ক‌ইরা তোরে ছাইরা গেসে।কাজ ক‌ইরা খাঁ।  সংসারে দুইডা পয়সা আননের চেষ্টা কর। ব‌ইয়া ব‌ইয়া খাবি লজ্জা লাগে না? যা রাস্তায় ব‌ইয়া মাল বিক্রির চেষ্টা কর।" 
শীতল সরকার এপার বাংলায় পা রেখেই একটা কাজ জুটিয়ে নেয়। বিজয়কে এইভাবে পড়া ছাড়িয়ে মাল দিয়ে রাস্তায় বসিয়ে দেবার জন্য বিভাকে যার পর নাই তিরস্কার করে। বিজয় শীতল কে দাদু আর বিভাকে দিদা বলে ডাকে। শীতল বিভাকে বলে, " তুমার কি কান্ডজ্ঞান নাই। ও তুমার নাতির মতন। ওরে তুমি স্কুল যাইতে না দিয়া মাল ব্যাচতে ক‌ও। তোমারে ল‌ইয়া আর পারুম না। এহন যদি ওর বাড়ির লোক আইয়া দেখে আমরা ওরে দিয়া কাজ করাই, কী ভাইব্য!"
প্রতিবাদ করে বিভা বলে, " হ্যাঁ, আইয়া পড়বো বললেই পড়বো। দেখ গে ওর হাত ছাড়াইয়া চৈলা গ্যাসে। ওর দায় কি আমাদের? এই বিপদের দিনে কে কার দায় ল‌ইতে চায়? বয়াইয়া বয়াইয়া খাওয়াইতে পারুম না।"

দেখতে দেখতে বিজয়ের বয়স নয় দশ হতে চললো। এ বাড়িতে ওর প্রতি নির্যাতনের মাত্রা বেড়েই চলল। মাল বিক্রি সব দিন সমান হয় না।  কোন দিন হয় আবার কোন দিন হয়‌ই না। যেদিন একদম কম হয় কিংবা হয়‌ই না, সেদিন চড় চাপড় তো খেতেই হয়, উল্টে খাবারের থালায় খাদ্যের পরিমাণ কমে যায়। একটা সমর্থ উঠতি বয়সের ছেলের এখন খাবার বয়স। ডায়েটিংয়ের ধার ধারার কথাই নয়। প্রয়োজনাতিরিক্ত না হোক প্রয়োজন মাফিক তো হ‌ওয়া উচিত যেখানে আর সকলে পেট ভরে খাবার খায়। ছেলেটা খিদে পেলে কলের জল খেয়ে কাটায়। এক এক সময় খালি পেটে জল‌ও খেতে পারে না। পেটে লাগে। মাঝে মাঝে শীতল দাদু তার কর্ম ছেড়ে এসে ওর সঙ্গে রাস্তায় দেখা করে। খিদে পেয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করে, 
" কিরে খিদা পাইসে? এই নে ধর খাইয়া ল। বাড়িতে কিসু ক‌ওনের দরকার নাই। আমি এহন যাই।"
বিজয়ের এ বাড়িতে মন টেকে না। কিন্তু এই লোকটার জন্যে যেতে পারে না। শীতল দাদুর বয়স হয়েছে। তবুও খাটতে যায়। আচ্ছা, দিদা কেন দাদুর মতো হল না। সব মানুষ তো সমান হয় না। হলে তো সব গোল মিটে যেতো। দুপুরে বাড়ি ফিরলে বিক্রি বাটা নিয়ে তো এক চোট হবে, তার ওপর বোনের জামা কাপড়, দিদা দাদুর জামা কাপড়, ওর নিজের জামা প্যান্ট সব সাবান দিয়ে ভেজানো আছে ঝিলের জলে গিয়ে কাচতে হবে। তারপর স্নান করে তবে দুটো খেতে পাবে। 

এ কষ্টের জীবন বিজয় আর স‌ইতে পারে না। ওর নিজের বাবা মার কথা মনে পড়ে। ওরা কোথায় আছে কেমন আছে কে জানে?  তাদের কি ওর জন্য চিন্তা হয় না? নাকি ওকে ছাড়া তারা খুব ভালো আছে হয়তো। দিদা যে মাঝে মাঝে বলে, ওর বাবা মা ওকে ইচ্ছে করেই ছেড়ে চলে গেছে। এটা কি সত্যি। কি জানি, হবে হয়তো।বিজয় এখন আর বাচ্চাটি নেই। বয়স পনেরো ষোল। সব বুঝতে শিখেছে। অন্তত অবস্থা পরিস্থিতি তাকে বুঝতে শিখিয়েছে।একদিন একদম বিক্রি হয় নি । দুপুরে বাড়ি ফিরতেই দিদা বললো, "দেখি কতো হ‌ইসে আজ।"
—দিদা ,আজ একটাও খদ্দের হয় নাই।
যেই না বলা, দিদার মাথায় যেন রক্ত চড়ে গেলো, বললো," দূর হ‌ইয়া যা। কী ভাবছস্ ? ভাত বাইড়া রাখসি। আইয়া খাইয়া আমারে উদ্ধার করবি। চোক্ষের সামনা থিক্কা দূর হ‌ইয়া যা।" বলে একটা লাঠি নিয়ে তাড়া করলো। বিজয় বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলো, আর ঢুকলো না। সারাদিন খালি পেটে ঘুরে 
বেড়াতে লাগলো। খিদের জ্বালায় শরীর অবসন্ন হয়ে এলো। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পায় কতো দোকানের সামনে কতো খাবার সাজানো আছে। তবুও ও খাবার ছোঁয়া যাবে না,কারণ পকেটে একটাও পয়সা নেই। মুখে লালা জমছে, তা ঘিটে নিতে হচ্ছে। একটা দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। দোকানদার জিজ্ঞাসা করলো, 
"এই কী চাই?"
— বাবু বড্ড খিদে পেয়েছে কিছু দেবেন?
দোকানদার তার কর্মচারীকে বললো, "এই খদ্দেরের পাতে পড়ে আছে যেগুলো ওকে দিয়ে দে , আর টেবিলটা পরিষ্কার করে দে। কর্মচারী থালা থেকে উচ্ছিষ্ট নিয়ে বিজয়কে বললো, "এই নে ধর।" ক্ষুধা কোন মান সম্মান, কোন বাছ বিচার মানে না। খিদের সময় যা পাওয়া যায়,চোখ বুজে খেয়ে নিতে হয় । অবশ্যই বিষ হলে নয়। হাত পেতে নিয়ে মুখে পুরে দিয়ে  বিজয়  রাস্তার কলের জল খেয়ে পেট ভরিয়ে নেয়। তারপর 'মাই লাভ' নামের একটি ক্লাবের বাইরের রোয়াকে বসে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করতে থাকে। এমনসময় ঐ ক্লাবের সভাপতি ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ছেলেটিকে ওই ভাবে কাঁদতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে জিজ্ঞাসা করলেন, " এই খোকা, তুই কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে তোর? "
বিজয় সবিস্তারে সব কথা বলে চললো। সভাপতি মহোদয় সব কথা শুনে ওকে একটা দোকানে নিয়ে গিয়ে পেট ভরে খাওয়ালেন। তারপর ক্লাবের সম্পাদকের কাছে নিয়ে গেলেন। সম্পাদককে সব কথা বলে বললেন," একে ক্লাবের পিছনে যে ঘরটা ফাঁকা আছে ওখানে থাকতে দিলে হয় না? 
সম্পাদক বললো," হ্যাঁ, হ্যাঁ থাকতে পারে। বরং ভালোই হবে। ঘরটা পরিষ্কার থাকবে। থাকার ব্যবস্থা নয় হলো কিন্তু খাবে কী?  কটা দিন নয় এর ওর বাড়ি থেকে দিয়ে চালিয়ে দেওয়া যাবে। তারপর একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়া যাবে। তবে শিশু শ্রমের দিকটাও তো ভেবে দেখতে হবে।

বিজয় ক্লাবে থাকার জায়গা পেয়ে গেলো। কদিনের খাওয়ার ব্যবস্থাও হয়ে গেলো। এবার একটা শ্রমহীন কাজের ব্যবস্থার কথা ভাবা হতে লাগলো। বাপি নামের একজন সদস্য  বাড়ি কেনাবেচা ও ভাড়ার দালালি করতো। সে একটা প্রস্তাব দিলো, " আচ্ছা আমি ওকে একটা হাল্কা কাজ দিতে পারি। তাতে ওর চলে যেতে পারে।" সকলে জিজ্ঞাসা করলো, "কী রকম কাজ?"
—দালালির কাজ। ওকে কিছু করতে হবে না। ওকে একটা সাইকেল দিয়ে দিলেই হলো।
সে নয় আমি একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারি। লালনের দোকানে একটা সাইকেল পড়েই রয়েছে। একটু সারিয়ে নিলেই হবে। লালনকে মাসে মাসে পয়সা দিয়ে দিলেই হবে। ও শুধু সাইকেল নিয়ে দেখবে কোথায় বাড়ি খালি হচ্ছে সেই খবরটা আমায় এনে দেবে। ব্যাস। ভাড়াটে হলেই ও  ওয়ান থার্ড টাকা পেয়ে যাবে। আর বাড়ি কেনাবেচা হলে তো কথাই নেই। ভালো টাকা পেয়ে যাবে। শুধু পার্টির সঙ্গে একটু যোগাযোগ করা।
"ব্যাস। তাহলে কাজে লেগে পড়। কি পারবি তো?" সম্পাদক জিজ্ঞাসা করলো।
বিজয় খুশি হয়ে ঘাড় নাড়লো।
সেই থেকে বিজয় বাড়ি ভাড়ার দালালির কাজে বহাল হয়ে গেলো। পুরো দমে কাজ চলতে থাকে। বয়স‌ও থেমে নেই । বয়সের ও কাজের সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞতাও বেড়ে চললো। একদিন সঞ্জয় নামের এক ভদ্রলোক পুরানো বাড়ি কিনবার জন্য এলো বিজয়ের কাছে। সঞ্জয় অনেকক্ষণ ধরে বিজয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে করার চেষ্টা করে কোথায় যেন দেখেছে এই ছেলেটাকে। কিন্তু মনে করতে পারছে না। অথচ বড্ড চেনা চেনা লাগছে। অবশেষে কৌতুহল মেটাতে জেরা করতে শুরু করলো, " আচ্ছা তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করবো কিছু যদি মনে না করো। 
" না না, বলুন না। কিছু মনে করবো না।"  বিজয় বললো। 
—তোমার নাম যেন কি?
— আমার নাম বিজয়।বিজয় সরকার 
— সরকার? বাড়ি কোথায়?
—বাড়ি ছিলো বাংলাদেশে।
—বাংলাদেশের কোন জিলায়?
—ময়মনসিং ।
—বাবার নাম?
—সঞ্জয় দাশ।
—দাশ কেনো ? তুমি তো সরকার।
—এর পিছনে একটা গল্প আছে।
—কী গল্প?
— ওখান থেকে চলে আসতে হলো। এসে উঠেছিলাম  বিধান কলোনিতে। যখন আসি তখন আমি এই বছর আষ্টেকের। 

 সব কিছু আস্তে আস্তে মিলে যাওয়াতে সঞ্জয়ের কৌতুহল বাড়তে লাগলো। বললো,
" তারপর?"
—তারপর , এক ফ্যামিলির পিছনে পিছনে চলে এসে তাঁদের‌ই কাছে উঠলাম। যদিও তাঁর স্ত্রী রাজি ছিলেন না। বয়স্ক ভদ্রলোক খুব‌ই ভালো। তাঁর‌ই দয়ায় আমি বেঁচে গেছি। নাহলে যে কী হতো! তাঁর স্ত্রীর নির্যাতনে ওনাকে না বলেই চলে আসতে বাধ্য হয়েছি। তবে তাঁর ঋণ শোধ করতে পারবো না।
—ভদ্র লোকের নাম কি?
—শীতল।
—নিশচয়‌ই  সরকার?
—আপনি চেনেন?
—না।
—তবে 'সরকার' কি করে জানলেন?
— কারণ সবটাই মিলে যাচ্ছিলো। শুধু পদবীটা। তোমাকে উনি ওনার পরিচয়ে মানুষ করেছেন বলে তুমি ওনার পদবী ব্যবহার করছো। না হলে তোমার আসল পদবী 'দাশ'। কি তাই তো?
—হ্যাঁ।
—তোমার বাবার নাম সঞ্জয় দাশ।আর সেই ব্যক্তি হলেন আমি। 
—আপনিই আমার বাবা?
সঞ্জয় দাশ ঘাড় নেড়ে বললো,
"হ্যাঁ, আমিই তোমার বাবা। তোমাকে এতো দিন পর খুঁজে পাবো ভাবিনি। আমরা তো আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম।সব‌ই ওই কল্যাণময় ঈশ্বরের ইচ্ছা। রাখে হরি তো মারে কে?

এদিকে বিজয় সেই যে বেরিয়ে গেলো আর ফিরলো না দেখে শীতল সরকার  বিভাকে বারবার বকতে লাগলো," তুমি ওরে শেষে তাড়াইয়াই ছাড়লা। একটা মানুষ কতদিন সহ্য করতে পারে। সহ্যের‌ও তো সীমা আছে। তোমার মনে এতো হিংসা!  ছিঃ! ছিঃ ! তোমারে ল‌ইয়া আর পারন যায় না।" শীতল সরকার গজগজ করতে করতে বাইরে বেরিয়ে গেলো পথে কোথাও বিজয় রাগ করে বসে আছে কিনা দেখতে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর বিষন্ন মনে ঘরে ফিরে এলো। সেই থেকে মনেপ্রাণে ভেঙে পড়লো। কাজে কর্মে মন দিতে পারছিলো না। আসলে তার কোন পুত্র সন্তান ছিলো না। সকলেই শেষ বয়সে পুত্র সন্তানের অভিভাবকত্ব চায়। এক্ষেত্রে বিজয়কে পেয়ে তাই হয়তো চেয়েছিলো। যেটা  তার স্ত্রীর মাথায় আসেনি। বার্ধক্যে এসেও বার্ধক্য যাকে স্পর্শ করতে পারেনি, সেই লোকটাই যেন রাতারাতি বার্ধক্য পীড়িত হয়ে পড়লো। তাই অর্ধেক দিন কাজে যাওয়া বন্ধ করে দিলো, কাঁধে যার দু দুটো লোকের দায়িত্ব আছে। সংসারের হাল যেন বেহাল হয়ে পড়লো। নাতনিকে নিয়েই ওর যতো চিন্তা। ওর তো একটা ভবিষ্যৎ আছে। বড়ো হলে বিয়ে দিতে হবে, তার সংস্থান থাকা চাই। শুধু হাতে তো বিয়ে হবে না। না হলে বুড়ো বুড়ি যেমন করে হোক চলে যেতো। মালিক একদিন শীতল সরকারকে ডেকে বললেন,
"শীতল, তোমার বয়স হয়েছে। তোমার দ্বারায় কাজ করা আর সম্ভব নয়। এভাবে কামাই করলে তো আমার চলবে না। তোমাকে নেওয়াই আমার ভুল হয়েছে। তুমি সদ্য ওপার বাংলা থেকে এলে, কাজ নেই,বললে তুমি পারবে, তাই নিয়ে ছিলুম। তোমার পাওনা গন্ডা বুঝে নিয়ে তুমি চলে যাও। কাজটা হারিয়ে সংসারে নেমে এলো অসীম শূন্যতা।

দীর্ঘদিন পর হঠাৎ বিজয় ফিরে এলো একজনকে সঙ্গে নিয়ে। এসে বললো,"দাদু, আমি এসেছি আমার বাবাকে সঙ্গে নিয়ে। শীতল ফ্যালফ্যাল করে মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
" বাবা! মানেটা ঠিক বুঝলাম না।"
বিজয়ের বাবা এগিয়ে এসে বললো," নমস্কার, আমার নাম সঞ্জয় দাশ। সেদিন যে অনাথ পোলাডারে আপনি আশ্রয় দিয়ে সিলেন সেই বিজয় আমার‌ই সন্তান। আপনার ঋণ আমি কুনোদিন শোধ করতে পারবা না। তবু আমারে কিছু করার সুযোগ দ্যান। বিজয়ের সঙ্গে আমার কাকতালীয়ভাবে  দেখা হ‌ইয়া যায় ও আপনাদের কথা সব আমারে ক‌ইসে।" কথাগুলো শুনে শীতল সরকার বললো, " আমাদের কথা সব আপনারে ক‌ইসে? আর এটা কয়নাই  যে আমার স্ত্রী বিভা ওরে বাড়ি হ‌ইতে তাড়াইয়া দিসে?"
— বেশ তো, দিদা হ‌ইয়া শাসন  করতেই পারে। 
— নিশ্চয়ই পারে। তবে বাড়ি হ‌ইতে তাডাইয়া দিয়া নয়।
— আপনি একজন সজ্জন মানুষ।  নাতি ভাইব্যা আপনি ওরে কাসে রাখসেন । আপনারে ও ভুলতে পারে নাই। তাই তো ক‌ই আমারে  কিসু করণের সুযোগ দ্যান।  বিজয়  ওর বোনের জন্য কিছু করতে চায়। ওর দায়িত্ব আমরা ল‌ইতে চাই।আপনে আর অমত করেন না। একদিন আপনি ওরে বাঁচাই সেন, আজ ও আপনার নাতনিরে বাঁচাইতে চায়। এ ভাবেই তো আমরা পরষ্পরের পাশে থাকুম।
— তা আপনারা এখন আসেন কুথায়?
—আমরা এহন আসি সাঁতরাগাছির জি আই পি কলোনিতে।
— ওহনে যাইয়া উটসেন। তা পোলার খোঁজ করেন নাই?
—করসিলাম।কুথাও হদিশ করতে পারি নাই। সব‌ই উপর‌ওলার হাতে ছাইড়া দিয়া সিলাম। ওর মা কয়দিন একটা খাবার দাঁতে কাটে নাই।  অনেক বুঝাইয়া সুজাইয়া ওরে সামলাইসি। এহন মাঝে মধ্যে হা হুতাশ করে।
 সব শুনে বিভা ভাবে— ভগবান আছেন। না হলে বিজয় ওর বাবাকে খুঁজে পাবেই বা কেন, আর এই দুর্দিনে ওদের নাতনির দায় ওরা নিতে চাইবেন‌ই বা কেন।

পিতৃমাতৃহারা বিজয়ের প্রতি  দুর্ব্যবহারের অপরাধ বোধ বিভাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল।তাই এগিয়ে এসে বিজয়ের বাবার কাছে জোড় হাত করে ক্ষমা ভিক্ষা করতে লাগলো তার দুর্ব্যবহারের জন্য। মনে মনে ভাবলো—সেদিন ওর স্বামী বিজয়ের বাপ মায়ের অনুপস্থিতিতে বাবার মতোই ওকে কাছে টেনে নিয়েছিলো বলেই বিজয় আজ ছেলের কর্তব্য পালন করতে এগিয়ে এসেছে। মহৎ কর্ম কখনো বিফলে যায় না।
===================

Samir Kumar Dutta
Pune, Maharashtra 


No comments:

Post a Comment